নৌকার সঙ্গে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সংঘাত বাড়ছে
১১ ডিসেম্বর ২০২৩নির্বাচন কমিশন প্রার্থীতা চূড়ান্ত করলে এই সংঘাত আরো বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
প্রাথমিক বাছাইয়ে অনেক স্বতন্ত্র আর বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোননয়ন বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং অফিসাররা৷ কিন্তু এখন নির্বাচন কশিনের আপিলে তাদের অনেকেই প্রার্থীতা ফিরে পাচ্ছেন৷ আর তা নিয়ে মাঠের উত্তাপও বাড়ছে৷ সেই উত্তাপে সংঘাতও বাড়তে পারে৷
তফসিল ঘোষণার দিন ১৫ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন এলাকায় তফসিলকে স্বাগত জানাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে৷ হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে ১৫ নভেম্বর রাতে তফসিলের পর আনন্দ মিছিল করতে গিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ এতে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ১৬ জন আহত হন৷ একই দিন ঝালকাঠিতে যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছয় জন আহত হন৷ ওই দিন মোটর সাইকেল নিয়ে শহরের যুবলীগের দুই গ্রুপ মহড়া দিয়ে শক্তি দেখাতে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত লেগেই আছে৷ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বেশি প্রার্থীর আশায় স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করায় সংঘাত আরো বেড়ে যায়৷ কারণ বিদ্রোহী ছাড়াও অনেক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন৷ আওয়ামী লীগ থেকে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের জন্য বড় চাপ হলো বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী৷ ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগ থেকেই এবার ৪৪২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন৷ আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে প্রার্থী দিয়েছে৷ এখন ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে তাদের আসন সমঝোতা হলে এই সংখ্যা কমবে৷ সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া ৪৫-৫০ জন শেষ পর্যন্ত বঞ্চিত হতে পারেন৷ আর সেজন্য ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ কিন্তু স্বতন্ত্র আর বিদ্রোহী আতঙ্ক সবার জন্যই থেকে যাচ্ছে৷ বড় একটি অংশের মনোনয়নপত্র রিটার্নিং অফিসাররা বাতিল করলেও তারা আপিলে আবার ফিরে পাচ্ছেন৷ ফলে নতুন করে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে৷
নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের এই পর্যন্ত এইসব প্রার্থীতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় বেশ কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷ সর্বশেষ সোমবার (১১ ডিসেম্বর) ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জামাল হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে কয়েকদফা সংঘর্ষে পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ ভোট চাওয়া নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়৷ সংঘর্ষে দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়৷
গত ২৭ নভেম্বর মাদারীপুরের কালকিনিতে প্রার্থীতা নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচ জন আহত হন৷ আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুস সোবহান গেলাপ ও বিদ্রোহী প্রার্থী তাহমিনা সিদ্দিকীর সমর্থকদের মধ্যে ওই সংঘর্ষ হয়৷ ৩০ নভেম্বর নোয়াখালীর সেনবাগে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোরশেদ আলম এবং বিদ্রোহী প্রার্থী আতাউর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়৷ এতে পুলিশসহ বেশ কয়েকজন আহত হন৷ একই দিনে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডে নৌকার প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসের শাহরিয়ায়র জাহেদির সমর্থকদের মধ্যে সঘর্ষ হয়৷ তাদের সমর্থকদের মধ্যে এরপর ৬ ডিসেম্বরও সংঘর্ষ হয়েছে৷ ২ ডিসেম্বর শরিয়তপুরের নড়িয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং স্বতন্ত্র বিদ্রোহী প্রার্থী খালেদ শওকত আলীর সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়৷ সংঘর্ষে হাত বোমার বিস্ফোরণও ঘটে৷ এতে উভয় পক্ষে ১০ জন আহত হন৷ পঞ্চগড়-১ আসনের নৌকার প্রার্থী নুরুজ্জামান ভুঁইয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাড় ভেঙে দেয়ার হুমকি দেন ৬ ডিসেম্বর৷
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভুঁইয়ার পক্ষে কাজ করায় আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে ৮ ডিসেম্বর৷ ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হকের লোকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের লোজনকে মারধর করেছে বলে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে ৯ ডিসেম্বর৷
কয়েকটি এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এবার হেসে খেলে পাস করতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে নমনীয় অবস্থান জানানোর পর তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যান৷ তাই তারা বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দমাতে চাইছেন৷ ফলে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে৷
এদিকে সামনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ কারণ প্রাথমিক বাছাইয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক স্বতন্ত্র এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করলেও আপিলে তারা অনেকেই প্রার্থীরা ফিরে পাচ্ছেন৷ তাই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের যে আশা দেখিয়েছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা সেই আশা উবে যাচ্ছে৷ জানা গেছে যারা এমপি হিসেবে এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের অনেকেরই জনপ্রিয়তায় বেশ ভাটার টান৷ বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্ররা তাদের ঘুম হারাম করে দিতে পারেন যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়৷ ফলে নৌকার প্রার্থীরা এখন স্বতন্ত্র এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মরিয়া৷
তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘‘স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা ধরনের গ্রুপিং থাকে সেখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে৷ নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ এবং সবাই তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন৷’’
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘কোনো প্রার্থী তিনি দলীয়, বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হোন না কেন নির্বাচন কমিশন সবার প্রতি সমান আচরণ করবে৷ সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি করবে৷’’
আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের নির্বাচন উৎসবের মতো৷ যুগ যুগ ধরে নির্বাচনে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়ে আসছে৷ সেই তুলনায় এটা কিছুই না৷ পয়েন্ট জিরো থ্রি পার্সেন্ট৷ এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেক ভালো আছে৷ তবে আমরাও চাই সংঘাত-সংঘর্ষ যাতে একদমই না হয়৷’’
তার কথা, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যেরকম বলেছেন সেভাবেই হবে৷ সব প্রার্থী সমান সুবিধা পাবেন৷ দলীয়, স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সবার প্রতি সমান আচরণ করা হবে৷ যারা যোগ্য, জনপ্রিয়, যাদের ভোটাররা ভোট দেবেন তারা নির্বাচনে জয়লাভ করবেন৷’’
আর জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘‘এবার নির্বাচনে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ সরকারের ভোটারের উপস্থিতি বাড়াতে স্বতন্ত্র, নিজ দলের বিদ্রোহী সবার জন্য প্রার্থীতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে৷ এতে যারা শাসক দলের প্রার্থী তারা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে আছেন৷ তারা অনেকটা তাই ডেসপারেট হয়ে উঠেছেন৷ সামনে এই পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে৷’’
তিনি রিটার্নিং অফিসারদের কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, ‘‘প্রার্থীতা বাতিলের ক্ষেত্রে তারা ন্যায্য আচরণ করেননি৷ ফলে আপিলে তাদের প্রার্থীতা আবার টিকে যাচ্ছে৷’’
তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য শতকরা এক ভাগ ভোটারের সমর্থন প্রথার সমালোচনা করে বলেন এতে ভোটারের গোপনীয়তা ভঙ্গ হয়৷ তাই এই নিয়ম বাতিলের দাবি করেন তিনি৷