নিষেধাজ্ঞার মুখে স্থগিত হলো জাতীয় পার্টির সমাবেশ
১ নভেম্বর ২০২৪শুক্রবার দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ‘যে কোনো মূল্যে সমাবেশ করার' ঘোষণা দিলেও পরে সেই সমাবেশ স্থগিত করা হয়৷
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতা'র ব্যানারে একদল লোক একটি মিছিল নিয়ে রাজঘধানীর বিজয় নগরে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে যান। সেখানে তাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে ওই কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। পরে জানানো হয় শনিবার পার্টি অফিসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। অন্যদিকে তাদের সমাবেশ করতে না দেয়ারঘোষণা দেন গণ অধিকার পরিষদের নেতা হাসান আল মামুন।
জাপার পার্টি অফিসে দেওয়া আগুনে নিচতলা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ভাঙচুর করা হয় আসবাবসহ অন্যান্য সামগ্রী। কার্যালয়ের দেয়ালে থাকা জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ম্যুরালেরও ক্ষতি করে হামলাকারীরা। জাতীয় পার্টির দাবি, তাদের ওপর আগে হামলা হয়েছে। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার ব্যানারে যাওয়া ব্যক্তিদের দাবি, তাদের ওপর আগে হামলা করেন জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সংলাপ করেছেন। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। ফেসবুক পোস্টে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে উল্লেখ করেন তারা। এতে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গত ১৪ অক্টোবর জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও নেতা সারজিস আলমকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।
গত ২৬ অক্টোবর আইজিপির সঙ্গে রংপুর যান সারজিস আলম। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাষ্ট্র পুনর্গঠনে তারুণ্যের ভাবনা' শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সারজিস বলেন, ‘‘গত ১৬ বছরে, বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার সরকারকে যারা বৈধতা দিয়েছিল, তারা সবাই ওই ফ্যাসিস্টের দোসর। জাতীয় পার্টি যদি সংসদে আওয়ামী লীগকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা না করতো, তাহলে আওয়ামী লীগ ন্যূনতম যে বৈধতা পেয়েছিল, সেটা কি পেতো?''
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, ‘‘এই জাতীয় পার্টির বন্ধুগণ, এই সুবিধাবাদীরা, নিজেরা বিরোধীদলীয় ভূমিকায় আসে একটা গাড়ি পাওয়ার জন্য, মন্ত্রিপাড়ায় একটা বাড়ি পাওয়ার জন্য, কিছু বেতন পাওয়ার জন্য, এমপির সিটটি পাওয়ার জন্য, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি করার জন্য। এখন তারা ভালো সাজতেছে। দেশকে এই অবস্থায় আনার জন্য এদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে।''
সারজিস গেলেও হাসনাত আবদুল্লাহ রংপুরে না যাওয়ায় এক ধরনের বিজয় উল্লেখ করে ওইদিন লাঠিমিছিল করে জাপা। বিষয়টিকে এক ধরনের বিজয় বলে উল্লেখ করেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান।
জাপা কার্যালয়ে হামলা
গণ অধিকার পরিষদের নেতা হাসান আল মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যে দলটির চেয়ারম্যানসহ অনেক নেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রয়েছে, তারা কিভাবে প্রকাশ্যে সমাবেশ করতে চায়? তারা ঘোষণা দিয়েছে ২ নভেম্বর বিজয়নগরে সমাবেশ করবে। আমরা তো এই দলের নেতাদের গ্রেপ্তারের দাবি করছি। সেখানে তারা সমাবেশ করে কিভাবে? এই কারণে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বৃহস্পতিবার মিছিল নিয়ে বিজয়নগর যাচ্ছিলাম।'' তার দাবি, ‘‘সেখানে তাদের পার্টি অফিস অতিক্রম করার সময় আমাদের মিছিলে অতর্কিত হামলা করা হয়। সেখানে তাদের সঙ্গে পল্টন থানা যুবলীগের নেতারাও ছিলেন। হামলার খবরে ক্যাম্পাস থেকে আমাদের বন্ধুরা উদ্ধারে আসেন।”
ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার ব্যানারে ‘পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অপতৎপরতা ও দেশবিরোধী চক্রান্তের প্রতিবাদে' মশালমিছিল কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন গণ অধিকার পরিষদের ছাত্রসংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সন্ধ্যা সাতটার দিকে ফেসবুকে একটি পোস্টে বলেন, ‘‘জাতীয় বেঈমান এই জাতীয় পার্টি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিজয়নগরে আমাদের ভাইদের পিটিয়েছে, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। এবার এই জাতীয় বেঈমানদের উৎখাত নিশ্চিত।' এর কিছুক্ষণ পর হাসনাত আবদুল্লাহ আরেকটি পোস্টে লেখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে রাত সাড়ে আটটায় মিছিল নিয়ে তারা বিজয়নগরে যাবেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক নেতা সারজিস আলম সাড়ে সাতটার দিকে ফেসবুকে একই রকম একটি পোস্ট দেন। তিনি লিখেন, ‘‘রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে আমরা বিজয়নগরে যাচ্ছি।'' পরে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল বিজয়নগরের উদ্দেশ্যে বের হয়। এর আগে রাত সোয়া আটটার পর বিজয়নগরে গিয়ে দেখা যায়, জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের নিচতলায় আগুন দেওয়া হয়েছিল। তা নিভিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তখনো ভাঙচুর চলছিল। পরে রাত ৯টার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য ও সেনাসদস্য জাপা কার্যালয়ের সামনে যান।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, তারা শনিবার কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে সমাবেশ করতে পুলিশের কাছে অনুমতি চেয়েছেন। দলের নেতা-কর্মীরা সমাবেশের প্রস্তুতি সভার জন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যার পর একটি মশালমিছিল নিয়ে একদল লোক তাদের কার্যালয়ে হামলা করেন। জাতীয় পার্টির কর্মীদের প্রতিরোধে হামলাকারীরা মার খেয়ে পালিয়ে যায়। আধা ঘণ্টা পর সংঘবদ্ধ হয়ে ফিরে তারা কার্যালয়ে আগুন দেয়। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস এসেছিল। তাদের আগুন নেভাতে দেওয়া হয়নি। এভাবে যদি একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে হামলা হয়, তাহলে দেশে কিসের গণতন্ত্র, কিসের রাজনীতি?
শুক্রবার জাতীয় পার্টি (জাপা)-র চেয়ারম্যান জি এম কাদের ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যে কোন মূল্যে আমরা শনিবার সমাবেশ করবো। একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকার আমাদের সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। আসলে আমরা এতদিন শক্তি দেখাইনি তো তাই সবাই আমাদের দুর্বল মনে করছে। আমরা সমাবেশ করবো, মারতে এলে মরবো। বিএনপি-জামায়াতকে তো তারা কিছু বলছে না, কারণ, তারা শক্তি দেখিয়েছে।”
তবে গণ অধিকার পরিষদের নেতা হাসান আল মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাদের সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। ছাত্র, শ্রমিক ও জনতা শনিবার জাপার প্রতিটি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেবে। তারা সারাদেশ থেকে বাসে ট্রাকে করে লোক এনে শক্তি দেখানোর চেষ্টা করছে। আমরা তাদের চেষ্টা সফল হতে দেবো না।”
এর আগে শুক্রবার দুপুরে জাতীয় পার্টির বনানীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জি এম কাদের বলেন, ‘‘আমরা কোনো অপরাধ করিনি। আমাদের জোর করে অপরাধী করা হচ্ছে। কেন করা হচ্ছে, আমরা জানি না। কেন জাতীয় পার্টি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তার উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি জাতীয় পর্যায়ের একটি রাজনৈতিক দল। বারবার আমাদের কবরস্থ করার পরও আমরা কবর থেকে উঠে এসেছি। কেউ আমাদের ধ্বংস করতে পারেনি। যেহেতু আমরা সহাবস্থানের রাজনীতি করি, আমরা দখলদারি করিনি, সন্ত্রাসের রাজনীতি করি না, হাট-মাঠ-ঘাট দখল করিনি, মানুষকে অত্যাচার-দলীয়করণ করিনি। আমরা মানুষকে সুশাসন দিয়েছি, উন্নয়ন দিয়েছি, সংস্কার দিয়েছি, গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছি। মানুষ তা স্মরণ করে।''
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অপরাধ-এমনটা পৃথিবীর কোথাও আছে কি না- এমন প্রশ্নও তোলেন জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘‘আমি রাজনীতি করি, আমার একটি দল আছে। আমার দল যার সঙ্গে ইচ্ছা অ্যালায়েন্স করব। যখন ইচ্ছা আমি নির্বাচন করবো, যখন ইচ্ছা আমি নির্বাচন করব না। এটা আমাদের দলের সিদ্ধান্ত, এখানে অপরাধটা কী? যখন আমি নির্বাচন করতে চাচ্ছি না, তখন আমাকে গায়ের জোরে নির্বাচনে নেওয়া হচ্ছে। আর যখন আমি নির্বাচনে গেলাম, তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাকে এবং আমার পরিবারকে হত্যা করার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।''
জাতীয় পার্টির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের প্রধান উপদেষ্টা (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) যাকে আমরা জাতির অভিভাবক মনে করি। তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। যেহেতু প্রধান উপদেষ্টার সবচেয়ে ক্লোজ লোক আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) কিছু বলেননি। তার মানে উনি মৌন সম্মতি দিয়েছেন বলে আমরা ধরে নিচ্ছি। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।''
আগুনের ঘটনায় মামলা হয়নি, কোন গ্রেপ্তার নেই
জাপা কার্যালয়ে আগুনের ঘটনায় শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলেও ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশ নার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান। সেখানে যেহেতু আগুনের ঘটনা ঘটেছে, সংঘর্ষ হয়েছে, সেক্ষেত্রে পুলিশ কোনো উদ্যোগ নিতে পারে কিনা জানতে চাইলে উপ-কমিশনার বলেন, "ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি অভিযোগ নিয়ে এলে আমরা সেটা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারি। যেহেতু কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেননি, ফলে আমরা কাউকে গ্রেপ্তার করিনি।”
শুক্রবার জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘ (পুলিশ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর) আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা শনিবারের বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি স্থগিত করেছি। এই সমাবেশ কর্মসূচি কবে করা হবে, পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানানো হবে।''