নির্বাচনের সময় নজরদারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
১৫ অক্টোবর ২০১৮‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স প্রোজেক্ট'-এর আওতায় প্রায় দেড়শ' কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ চলছে৷ এই প্রকল্পের আওতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে আপত্তিকর, ক্ষতিকর, বেআইনি পোস্ট ফিল্টার ও ব্লক করতে ডিভাইস বসানো হচ্ছে৷ নভেম্বরেই এর কাজ শেষ হওয়ার কথা৷ আইসিটি মন্ত্রনালয়ের এই ‘কোর' প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকার টেকভ্যালি সল্যুশন লিমিটেড৷ এই প্রকল্পে ২,৭০০ জিপিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করা হবে৷ এই ব্যান্ডউইথ পুরো বাংলাদেশ এখন যা ব্যবহার করে তার চারগুন৷
টেকভ্যালি সল্যুশন-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আহমেদ আদনান ডয়চে ভেলেকে গত মাসে জানান, ‘‘আমরা নভেম্বর থেকে আশা করছি অপারেশনে যেতে পারব৷ আইসিটি মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে আমাদের পাঁচ বছরের চুক্তি হয়েছে৷ আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট আনছি৷ তবে তাদের ইকুইপমেন্ট তৈরি হয় স্পেনে৷'' তিনি আরো জানান, ‘‘এর মূল কাজ হবে সাইবার থ্রেট প্রোটেকশন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইনের কন্টেন্ট ফিল্টারিং ও ব্লক করা৷ আমরা কি ওয়ার্ড ভিত্তিক কাজ করবো৷ সেখানে অপরাধমূলক, পর্ন বা দেশের জন্য, সমাজের জন্য ক্ষতিকর কিওয়ার্ড অন্তর্ভূক্ত থাকবে৷ থ্রেট এনালাইসিস করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷ বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইনে কন্টেন্ট ফিল্টারিং এবং ব্লকের কাজ এই পদ্ধতিতে এই প্রথম করা হচ্ছে৷''
বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা একই পদ্ধতিতে এখন সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট ফিল্টার করছে৷ তবে নতুন প্রকল্পে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাইরেও অন্যান্য অনলাইন কন্টেন্ট ফিল্টার করা হবে৷
এদিকেসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিল্টারিং এবং ব্লকিং-এর জন্যরেডিশন ডিজিটাল টেকনোলজি নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানও প্রকল্প জমা দিয়েছে বিটিআরসি'র কাছে৷ তারা শুধু নির্বাচনের সময় এবং আগে ও পরে মিলিয়ে ৬ মাস কাজ করতে চায়৷ এই কাজে খরচ দেখিয়েছে ৫০ কোটি টাকা৷
এদিকে গুজব শনাক্ত করতে গত ৯ অক্টোবর একটি মনিটরিং সেল গঠন করেছে তথ্য মন্ত্রনালয়৷ মনিটরিং সেল৷ তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন, ‘‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গুজব শনাক্ত করতে ৯ সদস্যের এই মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে৷ এই মনিটরিং সেল চলতি মাস থেকেই গুজব শনাক্ত করা শুরু করবে৷'' কমিটির প্রধান করা হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুর রহমানকে৷
কিভাবে গুজব শনাক্ত হবে জানতে চাইলে তারানা হালিম বলেন, ‘‘কোনো এলাকায় কোনো গুজব ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া গেলে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের ঘটনাস্থলে পাঠানো হবে এবং তাঁরা পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়কে ওই গুজব সম্পর্কে তথ্য দেবেন৷ ওই তথ্য যাচাই করতে গোয়েন্দাদের কাছ থেকেও তথ্য নেয়া হবে৷ পরে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিটিআরসি'কে ওইসব পেজ, লিংক বন্ধ করার জন্য অনুরোধের পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও জানানো হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘দেশ-বিদেশে প্রায় ৩০০ পেজ ব্যবহার করে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালানো হচ্ছে৷ এসব প্রচারণায় নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে৷''
অন্যদিকে নির্বাচনের আগেই আসছে ‘সাইবার পুলিশ সেন্টার'৷ ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী গুজব ছড়িয়ে কোনো ব্যক্তি, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি গোষ্ঠী অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে শনাক্ত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে এই সেন্টার গড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ তবে এখন পুলিশ সদর দপ্তরে একটি সাইবার ক্রাইম মনিটরিং সেল কাজ করছে৷
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার উত্তরায় এপিবিএন-এর একটি অনুষ্ঠানে আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া গুজব ঠেকাতে পুলিশের নতুন একটি ইউনিট গঠনের কাজ চলছে৷'' এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং অর্থমন্ত্রনালয়ের লোকবল, কাঠামো ও অর্থের অনুমোদন দিয়েছে৷
এদিকে ডয়চে ভেলে'র কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে চার মাস ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি চালাতে র্যাবকে দায়িত্ব দিতে একটি প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার৷''
‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যবেক্ষণ' শীর্ষক প্রকল্পের কাজ করবে র্যাব৷এই প্রকল্পের অধীনে ভোটের আগে দুই মাস ও পরে দুই মাস ফেইসবুক, ইউটিউব, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপসহ ইন্টারনেটে সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার, গুজব, মিথ্যা তথ্য, উস্কানিমূলক কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করবে র্যাব৷ এরইমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রাক মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় ১২১ কোটি ৪০ লাখ টাকার এ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷ চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিট (একনেক)-এর সভায় প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হবে৷
চার মাসের এ প্রকল্পটি র্যাব বাস্তবায়ন করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীনে৷
র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবানের কথা জানিয়ে বলেছেন,‘দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার উদ্দেশ্যে আমরা এ প্রকল্পটি বস্তবায়ন করব৷''
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি গত ৮ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়েছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি শক্তিশালী মাধ্যম৷ মানুষ এখন এই মাধ্যমে মত প্রকাশ করছে৷ কথা বলছে৷ সামাজিকক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডও হচ্ছে৷ কিন্তু বাংলাদেশে একই অপরাধ এমনিতে করলে যে শাস্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তা করলে শাস্তি অনেক বেশি৷ একই অপরাধে দুইরকম শাস্তির বিধান থাকা উচিত নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের যেসব উদ্যোগ সরকার নিচ্ছে, এর মধ্যে অন্য উদ্দেশ্য আছে৷ সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু আন্দোলন হয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে৷ তাই সরকার চাইছে নির্বাচনের সময় যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো জনমত সংগঠিত হতে না পারে৷ আগে ছিল তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা, এখন সরকার জিডিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে, যার অধিকাংশ ধারাই জামিন অযোগ্য৷ নির্বাচনের আগে নতুন আইন এবং এইসব নতুন নতুন উদ্যোগ এরইমধ্যে মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে৷ ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে৷ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে৷''
আর মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ায় সত্য, কিন্তু সেই গুজব কতজন বিশ্বাস করে? মানুষের ওপর আস্থা রাখতে হবে৷ কিন্তু কখনো কখনো মানুষ নিজের ছায়াকেও ভয় পায়, এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের আগে বিতর্কিত ডিজিটাল আইন করা হলো৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রনে, নানা যন্ত্রপাতি কিনতে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে কার ভয়ে? মানুষকে নানা দিক দিয়ে কেন বেঁধে ফেলা হচ্ছে? ছায়াকে ভয় পেলেই এরকম করা হয়৷''