নির্বাচনকালীন গণমাধ্যম : আশঙ্কা ও ভিসানীতি
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, সরকারি বিজ্ঞাপন পায় এরকম জাতীয় এবং আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা এখন ৫৭৬টি৷ সারা দেশে এমন সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক এবং ত্রৈমাসিক পত্রিকা আছে ১২৯টি৷ টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারে আছে ৩৯টি৷ আর তথ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল মোট ১৮২টি৷
১৭ কোটি মানুষের এই দেশে বাজার বিবেচনায় গণমাধ্যমের এই আকারকে অনেকেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মনে করেন৷ তারপরও নির্বাচনের আগে আরো কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারে বলে জানা গেছে৷ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের আবেদনও প্রক্রিয়াধীন আছে৷ নির্বাচনের আগে তারা অনুমোদন পাবে কিনা তা অবশ্য নিশ্চিত নয়৷ এছাড়া অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়৷
কিন্তু গণমাধ্যম অনেক বিস্তার লাভ করলেও তারা গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কতটা ভূমিকা রাখছে?
মোটা দাগে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়৷ তখন অবশ্য গণমাধ্যম এত বিস্তৃত ছিল না৷ অনলাইন তখনো আসেনি৷ আর টেলিভিশন বলতে একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন(বিটিভি)৷ সরকারের পক্ষে একপেশে প্রচারের কারণে তখন অবশ্য বিটিভিকে সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স বলা হতো৷ এখনো তার ‘চরিত্রে' বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ ওয়ান ইলেভেনের সময় সংবাদমাধ্যম যেমন বিরাজনীতিকরণের ভূমিকায় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবকধায়ক সরকারের হয়ে কাজ করেছে, আবার গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্য ভূমিকা রাখা গনমাধ্যমও ছিল অনেক৷ এরপর থেকে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বড় ধরনের বাঁক পরিবর্তনের কথা বলেন বিশ্লেষকরা৷
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, "এরশাদের পতনের আগে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো চারদিন বন্ধ ছিল৷ এটা এরশাদের পতনকে ত্বরান্বিত করে৷ জিয়াউর রহমানের সময় সাংবাদিক সম্পাদকরা গ্রেপ্তার হলেও তারা সত্য প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু এখন গণমাধ্যমের প্যাটার্ন পরিবর্তন হয়ে গেছে৷” তার কথা, "রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে৷”
বিশ্লেষকরা বলছেন ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা সুষ্ঠু ও অংশহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে দৃশ্যত তেমন কার্যকর ছিল না৷ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অনেকটা বিটিভির মতো সরকারের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ স্বাধীন সাংবাদিকতা সার্বিকভাবে চাপের মুখে আছে৷ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ মনে করেন," গত এক যুগ ধরে গণমাধ্যম চাপে আছে৷ সরকারে দিক থেকে বাধা আছে, আবার মালিক পক্ষের দিক ধেকেও বাধা আছে৷ মালিকরা তো পার্টিজান হয়ে গেছে৷ এখন সামনের ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচনের জন্য মিডিয়ার যে ভূমিকা রাখা দরকার, তারা তা পারবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে৷ ড. ইউনূসের বিপক্ষে যখন ৫০ জন সম্পাদক বিবৃতি দেয়, তখন বুঝতে হবে পরিস্থিতি কেমন৷”
তার কথা, "মুক্ত সাংবাদিকতায় বাধা এরশাদের বা তার আগেও ছিল৷ কিন্তু তখন গণমাধ্যমের মুক্ত সাংবাদিকতার চেষ্টা ছিল৷ এখন চেষ্টাও নেই৷ এর সঙ্গে নানা আইন তো আছেই৷ সম্পাদকরা এখন রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন৷” তবে মার্কিন ভিসা নীতির কারণে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন৷
বাংলাদেশে গণমাধ্যম সংখ্যায় এবং আকারে বড় হলেও তাদের প্রো-পিপল ভূমিকা কমে গেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক খান৷ বেসরকারি টেলিভিশনগুলো সরকারি প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ আর দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদে পত্রিকাগুলোও একই ভূমিকা রাখছে বলে তিনি মনে করেন৷ তার কথা, "সাংবাদিকরাও এখন আর ভালো প্রতিবেদন না করে কেউ কেউ যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থ আয়কেই প্রাধান্য দিচ্ছেন৷ বেতনের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের বিলাসী জীবন দেখলেই বোঝা যায় সাংবাদিকতা কোন দিকে গেছে৷”
তিনি বলেন, "জিয়া থেকে এরশাদের সময় সাংবাদিকরা চেষ্টা করেছেন বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে৷ কিন্তু এখন আর সেরকম হয় না৷ গত দুইটি নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবল নয়৷ সামনের নির্বাচনেও এর পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না৷”
"মার্কিন ভিসা নীতিও গণমাধ্যমকে বদলাতে পারবে না৷ কারণ, যারা গণমাধ্যমকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছেন, তারা অ্যামেরিকায় যাবেন না৷ তাদের সেই প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না,” বলেন এই অধ্যাপক৷
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মাগুরার উপ-নির্বাচন, এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগের আন্দোলন৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়রির নির্বাচন এবং ২০০৬ রাষ্ট্রপতি সালে ইয়াজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷ এই বিষয়গুলো নিয়ে বেসরকারি গণমাধ্যম সঠিক ভূমিকাই রেখেছিল৷ কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা সেরকম নয়৷
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক খান মনে করেন, "কর্পোরেট মিডিয়ার এখন নানা স্বার্থ৷ আর সেটা সরকারের সঙ্গে যুক্ত৷ ফলে গণমাধ্যম এখন আর আগের ভূমিকায় নেই৷ সামনেও এর পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না৷”
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এখন রাজনৈতিকভাবেও বিভক্ত৷ তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, নেতা৷ শ্যামল দত্ত বলেন, "রাজনৈতিক আদর্শ গণমাধ্যমের থাকতে পারে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আছে৷ সেখানেও গণমাধ্যম এখন কর্পোরেটদের দখলে৷ কিন্তু তারপরও সংবাদ পরিবেশনে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয়৷”
শওকত মাহমুদ বলেন, "রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা এক জিনিস আর বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ খবর পরিবেশন আরেক জিনিস৷ এটা আমরা আগে ফলো করেছি৷ রাজনীতির জায়াগায় রাজনীতি এবং সাংবাদিকতার জায়গায় সাংবাদিকতা রেখেছি৷ কিন্তু এখন একাকার হয়ে গেছে৷”
বাংলাদেশে একসময় দলীয় সংবাদপত্র ছিল৷ বাংলার বাণী ও দিনকাল তার বড় উদাহরণ৷ কিন্তু এখন সেই অর্থে সরাসরি দলীয় মালিকানায় সংবাদমাধ্যম নেই৷ তারপরও কেন এই অবস্থা? আর্টিক্যাল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার সাবেক প্রধান ফারুক ফয়সাল বলেন, "এখন ভিতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ নিজেদের লোকদের সংবাদমাধ্যম, পত্রিকা, টেলিভিশনের লাইসেন্স দেয়া হয়৷ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য আলাদা ব্যবসাও দেয়া হয়৷ দলের মালিকানায় সংবাদমাধ্যম থাকার চেয়ে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এই সময়ে৷”
এর বাইরেও আছে সরকারি বিজ্ঞাপনের ভাগ বাটোয়ারার বিষয়৷ আছে নানা কৌশলে চাপ৷ ফারুক ফয়সাল বলেন,"এরসঙ্গে এখন সম্পাদকরা সুবিধা নেয়ার চিন্তায় থাকেন৷ জিয়া এরশাদের আমলে এরকম সুবিধাদী অনেক কম ছিল৷ ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে চেষ্টা ছিল স্বাধীন সাংবাকিতার৷ এখন সেটাও নেই৷”
"আমি সামনে ভালো কিছু দেখছি না৷ নির্বাচন নিয়ে আমার সংশয় আছে৷ মার্কিন ভিসানীতিতে সাংবাদিকদের কেউ কেউ ভয় পেতে পারেন৷ কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গণমাধ্যম তেমন কাজ করবে বলে মনে হয় না৷”