1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নিউ নর্মালে খুব সুন্দর এক গ্রামে

২ অক্টোবর ২০২০

হালস্টাট, অস্ট্রিয়ার ছোট্ট একটি গ্রাম৷ বিশ্বের সুন্দর গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি৷ করোনাকালে সেই গ্রাম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সত্যি অন্যরকম নানা কারণে৷

https://p.dw.com/p/3jKSD
প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ মানুষ অস্ট্রিয়ার হালস্টাট গ্রামটিতে বেড়াতে যানছবি: picture-alliance/picturedesk.com/M. Holzner

প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ মানুষ ছোট্ট এই গ্রামটি ভ্রমণে যান৷ কারণ গ্রামটি সত্যিই ছবির মতো সুন্দর৷ আল্পসের কোলে ষোড়শ শতকের পুরোনো সব কাঠের বাড়ি আর লেক-সব মিলিয়ে অপূর্ব এই গ্রামের জনসংখ্যা ৯শ'রও কম৷

করোনায় সবাই যখন বাড়ির ভেতরে থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন কেন আমরা ঘুরতে গেলাম এবং তা-ও এমন একটা জায়গা বেছে নিলাম? আসলে মাতৃত্বকালীন ছুটির মধ্যে করোনা এসে গেল, শুরু হলো হোম অফিস৷ এক বছরের সন্তান, অফিস, পড়ালেখা-বাড়ি সব সামলাতে আমরা দু'জন এতটাই বিধ্বস্ত ছিলাম যে, মাথা কাজ করছিল না৷ কোথাও বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল৷ তাই বরের পিএইচডি থিসিস জমা দেয়ার পর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম৷ এরপর ঘুরতে যাওয়ার বিষয়ে নানা আলোচনা৷ কোন যাত্রায় করোনার বেশি ঝুঁকি৷ সন্তানের জন্য সুবিধা বিমানযাত্রা, কারণ, কম সময় লাগে৷ কিন্তু এক সহকর্মী কিছুদিন আগে ভিয়েনা ভ্রমণ করে এসে জানালেন বিমানে মাঝের আসন ফাঁকা রাখার কথা বলা হলেও আসলে ফাঁকা রাখা হয় না৷ তাই নিরাপত্তার কথা ভাবলে গাড়ি অথবা ট্রেন৷ যেহেতু আমরা দুজনেই গাড়ি চালাতে পারি না, তাই ট্রেন ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম৷ 

ভ্রমণের গন্তব্য বাছার এবং কোথায় থাকা হবে সে দায়িত্ব বরাবরই আমার৷ তো আমি সাম্প্রতিক বিভিন্ন ভ্রমণ ব্লগ থেকে যা জানলাম, তা হলো যেসব জায়গায় সাধারণত বেশি মানুষ ঘুরতে যায়, করোনায় সেসব জায়গাতেই লোক সমাগম তুলনামূলক কম৷ এসব ব্লগে ইউরোপের যে কয়টি জায়গার উল্লেখ আছে তার মধ্যে হালস্টাট একটি৷ ঠিক হলো হালস্টাট যাওয়া হবে ট্রেনে৷ ট্রিপ অ্যাডভাইজারে জানতে চাইলাম জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়া যেতে হলে চিকিৎসকের কোনো চিঠি লাগবে কিনা বা করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন আছে কিনা৷ জানতে পারলাম তেমন কিছুর দরকার নেই৷

ডয়চে বান-এর অনলাইন ওয়েবসাইট থেকে টিকেট কিনলাম৷ বুক করলাম ফ্যামিলি অ্যান্ড চিলড্রেন কম্পার্টমেন্ট, অর্থাৎ, যেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ যাতে না থাকে৷

এয়ারবিএনবিতে একটি অ্যাপার্টমেন্ট বুক করা হলো গ্রামের প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ৯০০ মিটার দূরে৷ যাওয়ার আগে বেশ কিছু জীবানুনাশক স্প্রে, দস্তানা, লোশন, টিস্যু পেপার কেনা হলো৷ যাত্রার জন্য বেছে নিলাম সোম থেকে শুক্রবার৷ কারণ, সপ্তাহান্তে ভিড় বেশি হতে পারে, সেটা এড়াতে৷

যথা সময়ে ট্রেন স্টেশন পোঁছে মাস্ক পরে নিলাম৷ কারণ, স্টেশনের ভেতরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক৷ ট্রেনে ওঠার সময়ও মাস্ক পরেই থাকতে হবে৷ নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্টে উঠে দেখলাম ছোট্ট ছিমছাম একটা ঘরের মতো৷ বাচ্চাদের জন্য ছবি আঁকা আছে, পাশেই টয়লেট, যেখানে ন্যাপকিন বদলানোর ব্যবস্থা আছে৷ উঠেই আমরা জীবানুনাশক স্প্রে দিয়ে পুরো কক্ষের সব কিছু মুছে ফেললাম৷ যেহেতু ওই রুমে আর কেউ নেই, তাই মাস্ক পরে থাকার শাস্তি থেকে মুক্তি পেলাম৷ তবে রুমের বাইরে গেলেই মাস্ক পরা বাধ্যতামুলক৷ একটা বগি পরেই ট্রেনের রেস্তোরাঁ, সেখানে যেতে যেতে দেখলাম অন্য বগিতে প্রত্যেক যাত্রী মাস্ক পরে রয়েছেন, তবে একই পরিবার বা দলের না হলে আসন ছেড়ে রেখে বসেছেন৷ মাস্ক পরাটা যে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তা দেখেই বোঝা যায়৷ ট্রেনের প্রতিটা স্টপে বার বার ঘোষণা হচ্ছিল মাস্ক পরে থাকার জন্য এবং সর স্বাস্থ্যবিধি যথাসম্ভব মানার জন্য৷ রেস্তোরাঁতেও এসব নির্দেশনা লেখা ছিল৷

একটানা ৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা জালসবুর্গ স্টেশনে পৌঁছালাম৷ সেখানে দেখলাম সবাই আরো বেশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে৷ অর্থাৎ, বন শহরে আমরা রাস্তাঘাটে মাস্ক পরি না৷ দোকানপাটে গেলে পরি৷ এখানে রাস্তাঘাটেও সবাই মাস্ক পরে আছেন৷ আর চেষ্টা করছেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার৷

জালসবুর্গ থেকে হালস্টাট যেতে তিনটি পথ আছে, একটি হলো বাস, যা দুইবার পরিবর্তন করতে হবে, অন্যটি ট্রেন সেটি একবার পরিবর্তনের পর ফেরি করে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে আর তৃতীয়টি গাড়ি৷ আমরা আগে থেকে অনলাইনে চালকসহ একটি গাড়ি ভাড়া করেছিলাম৷ স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন চেকপ্রজাতন্ত্রের চালক মাইকেল৷ চেক প্রজাতন্ত্রের বলে এই সার্ভিসে ট্যাক্সির তুলনায় ভাড়া কম৷ গাড়ির সামনের ও পেছনের আসনের মাঝে প্লেক্সিগ্লাসের আবরণ, চালক মাস্ক পরলেন, আমরাও পরে নিলাম৷ এরপর টানা দেড় ঘণ্টার যাত্রা৷ টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দিচ্ছিলো আল্পসের চূড়া৷

অপূর্ব ছোট ছোট সবুজে ঘেরা গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম হালস্টাটে৷ তখন সেখানেও বৃষ্টি৷ সন্ধ্যা নামার অপেক্ষা৷ এআরবিএনবির মাধ্যমে যে অ্যাপার্টমেন্টটি বুক করা হয়েছিল ড্রাইভার আমাদের ঠিক সেখানে পৌঁছে দিলো৷ হোস্ট ভদ্রমহিলা ওই বাড়িতেই থাকেন উপরতলায়৷ আর আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে নীচতলায়৷ উনি উপরতলা থেকে নেমে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন মুখে মাস্ক ছাড়াই, তবে হাত মেলালেন না সঙ্গত কারণে৷ তিনি আমাদের চাবিসহ সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে উপরে চলে গেলেন, বললেন কোনো দরকারে উপরে ডাক দিলেই হবে৷ আমরা ড্রাইভারকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকলাম৷ জানালা খুলতেই দেখা দিলো বিশাল পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে গায়ে মেঘ জড়িয়ে আছে, কী অপূর্ব সেই দৃশ্য৷ বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট পাহাড়ি নদী৷ তার কলকল শব্দ এখনো যেন কানে বাজে৷

আমরা যাত্রার সব পোশাক ছেড়ে সেগুলো আলাদা একটা ব্যাগে রেখে প্রথমে বাচ্চাকে গরম পানিতে গা মুছিয়ে একে একে গোসল করে নিলাম৷ তারপর খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়, এরপর আর কিছু মনে নেই৷

পরদিন সকালে উঠে জানালা দিয়ে আবারো পাহাড়ের দেখা মিলল৷ এবার তার অন্য রূপ৷ আমাদের সকালের খাবার ব্যবস্থা ছিল ওই অ্যাপার্টমেন্টেই৷ তাই নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে৷ প্রথমে একটি ম্যাপ নিয়ে বুঝে নিলাম কোথায় কী আছে৷ তারপর হাঁটা শুরু করলাম৷ সময় তখন সকাল সাড়ে ৯টা৷ খুব সুন্দর রোদ উঠেছে, তেমন ঠান্ডা নেই৷ অথচ রাস্তাঘাটে মানুষজন নেই বললেই চলে৷

এই গ্রামটি বিখ্যাত সাত হাজার বছরের পুরোনো লবণ খনির জন্য৷ সেই খনিতে উঠতে হয় কেবল কারে করে, যেটি আমাদের এয়ারবিএনবি’র একেবারেই পাশে৷ যেহেতু আমাদের পাঁচ দিনের ঘোরার পরিকল্পনা৷ তাই লবণ খনিটি দেখার জন্য শেষের দিনটি ঠিক করলাম৷ আর আজ এলোমেলোভাবে ঘোরা হবে ঠিক হলো৷ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম একটা পার্কে যেখানে শিশুদের খেলার জায়গা৷ আমাদের বাচ্চা সেখানে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা৷ পাশেই হালস্টাট লেক৷ পুরো গ্রামটি সেখান থেকে দেখা যায়৷ সেখানে গিয়ে দেখি, একটি মাত্র শিশু তার দাদা-দাদির সাথে খেলতে এসেছে৷ শিশুটি যে রাইডেই চড়ছে তার দাদা স্যানিটাইজার দিয়ে তা আগে মুছে দিচ্ছেন৷ আমরাও তাই করলাম৷

এরপর রওনা দিলাম গ্রামের কেন্দ্রে, যেটিকে বলে মার্কট, অর্থাৎ বাজারের কেন্দ্র৷ উদ্দেশ্য দুপুরের খাওয়া৷ দেখলাম, সব রেস্তোরাঁয় নির্দেশনা দেয়া- আগে বাইরে দূরত্ব মেনে দাঁড়াতে হবে৷ এরপর ওয়েটার এসে একজন করে নিয়ে যাবে৷ কারণ, যে অতিথি খেয়ে গেছেন, সেই টেবিল তারা জীবাণুমুক্ত করে পরিষ্কার করে তারপর অতিথিদের বসতে দিচ্ছিলেন৷ রেস্তোরাঁতেও যথারীতি খাওয়ার আগ পর্যন্ত মাস্ক পরে থাকতে হলো, ওয়েটাররা সবাই মাস্ক পরে ছিলেন৷ লেকের মাছ দিয়ে তৃপ্তির সাথে খাওয়া শেষ করলাম৷

এরপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সেখানকার বিশেষ ক্রিমরোল খাওয়ার জন্য লম্বা লাইন ধরতে হলো৷ ক্রিমরোল খেয়ে দিনের শেষ ফেরিতে চেপে বসলাম, উদ্দেশ্য লেক ভ্রমণ৷ ছোট্ট জাহাজের টিকেট কাউন্টারে লেখা ছিল, অল্প জায়গা বলে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা না গেলে পুরোটা সময় সবাইকে মাস্ক পরে থাকতে হবে৷ কিন্তু দিনের শেষ ফেরি বলে লোকজন খুব একটা ছিল না৷ তাই মাস্কবিহীন আমরা আরামেই একঘণ্টা নৌবিহার করলাম৷

এরপর রাতের জন্য খাবার বেঁধে নিয়ে চলে গেলাম অ্যাপার্টমেন্টে৷ এই গ্রামটি এত ছোট যে, কেউ যদি পাহাড়ে না ঘুরে কেবল গ্রামটা হেঁটে ঘুরে দেখতে চায় তাহলে একদিনই যথেষ্ট৷ এ কারণে এখানে অতিথিরা রাত কাটান কম৷ অন্য শহর থেকে এখানে এসে ঘুরে আবার ফিরে যান৷ এ কারণে সন্ধ্যা ৬টার পর দোকানপাট, এমনকি রেস্তোরাঁও বন্ধ হয়ে যায়৷

তবে করোনার কারণে মানুষজন একেবারেই কম৷ এখানকার লোকজন বলছিলেন, করোনার আগে প্রতিদিন মানুষের ভিড়ে হাঁটাই কষ্টকর ছিল, গাড়ি পার্ক করার জায়গা পাওয়া ছিল দুষ্কর, বেশিরভাগই চীনা পর্যটক৷ অথচ এবার কেবল পূর্ব ইউরোপের মানুষজনই বেশি দেখলাম এখানে৷ হালস্টাটের কাছেই চেকপ্রজাতন্ত্রের সীমান্ত৷

HA Asien | Amrita Parvez
অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

পরদিন পুরোদিন বৃষ্টি হলো৷ বিকেলের দিকে বৃষ্টি ধরে এলে হাঁটতে হাঁটতে শহরের কেন্দ্রে গিয়ে দেখি পর্যটক না আসায় দোকানপাট আগেই বন্ধ করে দিয়েছে৷

তৃতীয় দিন সকালে উঠেই ভালো আবহাওয়া দেখে ঠিক হলো লবণ খনি দেখতে যাবো৷ সকাল সাড়ে নয়টা থেকে কেবল কার চালু হয়, আমরা পৌনে দশটায় পৌঁছে দেখি আর মাত্র দুইজন আছে সেখানে৷ একটা কেবল কারে দুটো ভাগ৷ একটাতে আমরা তিনজন এবং অন্যপাশে আরো দুইজন মাস্ক পরে রওনা দিলাম৷

বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেয়া হালস্টাটের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ এই লবণ খনি, যেটি স্থলভাগ থেকে ৩৬০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত৷ উপর থেকে ৬০ বর্গ কিলোমিটারের ছোট হালস্টাটকে আরো অপূর্ব লাগছিল৷ সেখানে রেস্তোরাঁতেও সবাই সামাজিক দূরত্ব মেনে বসছিলেন৷ তবে স্কাইওয়াকের যে জায়গাটি থেকে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় ছবি তোলার জন্য অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বের কথা৷ উপরের এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য আসলে হয়ত সবাইকে ভুলিয়ে দিয়েছিল করোনার কথা৷

এদিন বিকেলে ষোড়শ শতাব্দীর কাঠের বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল আমরাও যেন সেই সময়ে আটকে গেছি৷ রাস্তায় শুধু আমরাই৷ সামনে স্থানীয় এক বৃদ্ধা হেসে আমাদের বাচ্চাকে একগোছা ফুল ধরিয়ে দিলো৷ মনে হলো যেন বললো আবারও পৃথিবীটা স্বাভাবিক হবে, ভয় পেয়ো না৷

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক অমৃতা পারভেজ৷
অমৃতা পারভেজ ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য