নাৎসি আমলের ছায়া এবং কোলোন সংগ্রহশালা
১৪ মে ২০১০কোলোনে যে বাড়িটিকে বর্তমানে নাৎসি ডকুমেন্টেশন সেন্টারে পরিণত করা হয়েছে তা ছিল ঘড়ি এবং অলঙ্কার ব্যবসায়ী লিওপোল্ড ডাহমেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান৷ ব্যবসায়ী লিওপল্ড ডাহমেনের নামানুসারেই নাৎসি ডকুমেন্টেশন সেন্টারের অপর নাম ইএল-ডিই হাউস৷
১৯৩৪ সালে গেস্টাপো (তত্কালীন জার্মান গোয়েন্দা পুলিশ) এই বাড়িটি ভাড়া নেয় এবং তা হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে৷ বাড়িটির নীচের দু'টি তলাকে পরিণত করা হয় কারাগারে৷ কারাবন্দিদের সেখানে তৈরি করতে হতো নিজেদের নির্যাতন কক্ষ৷ আর বাড়ির উপরের চারটি তলা জুড়ে গেস্টাপো তাদের ব্যবসায়িক কাজ চালাত র্নিবিঘ্নে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমা বর্ষণের ফলে কোলোন শহরের অন্তত নব্বই শতাংশ ধ্বংস হয়ে যায়৷ তবে, ঘটনাচক্রে এই বাড়িটি থেকে যায় অক্ষত অবস্থায়৷ যুদ্ধের সময়ে বাড়ির নীচের কারাগারটি ব্যবহার করা হত বিভিন্ন নথিপত্র রাখার গুদামঘর হিসেবে৷
যুদ্ধের পর এই বাড়িটিই ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন জাতীয় কাউন্সিলের অফিস হিসেবে, যেমন পেনশন বা অবসরভাতা দপ্তর, রেজিস্ট্রি অফিস ইত্যাদি৷ ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে গেস্টাপোর কারাগার মেমোরিয়ালটির উদ্বোধন করা হয়৷ এরপর ১৯৮৮ সালে কোলোন ন্যাশনাল সোশালিজম ডকুমেন্টেশন সেন্টার এই বাড়িটিতেই স্থানান্তরিত করা হয়৷ ১৯৯৭ সালের জুন মাসে বাড়িটি পরিণত হয় সংগ্রহশালায়৷
ইএল-ডিই হাউসের নীচের কারাগারটি প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় রেখেই দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে৷ কারাকক্ষগুলোর দেওয়ালে এখনও রয়েছে বন্দিদের বিভিন্ন ভাষায় লেখা ও আঁকা ছবি, যা কিনা সেই সময়ের ভয়াবহতাকে মনে করিয়ে দেয়৷ রয়েছে বন্দিদের কক্ষ, পয়োনিষ্কাশন সুবিধাসহ স্নানাগার, কারারক্ষীদের কক্ষ ইত্যাদি৷ তবে, নির্যাতন এবং ফাঁসি কক্ষটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
নাৎসি ডকুমেন্টেশন সেন্টারের গাইড জানান, ‘‘শহরের মাঝখানে অবস্থিত এই বাড়িতে নাৎসি কর্মকান্ড সম্পর্কে কোলোনবাসীর জানা থাকলেও তা তাঁরা হয় উপেক্ষা করতেন বা নাৎসিদের সেই নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডে সমর্থন জানাতেন নীরবে৷ তাছাড়া, বাড়িটি ব্যস্ত রাস্তার উপর হওয়ায় বিভিন্ন সময় বন্দিদের অসহায় আর্তনাদ বা যন্ত্রণার চিৎকার পথচারীদের কানে অবশ্যই আসতো৷ তবে, এই নির্যাতনের সাক্ষী এমন কেউই সে সম্পর্কে কোন ধরণের তথ্য দেননি৷''
সিক্রেট স্টেট পুলিশের কাজই ছিল মানুষের ওপর নজরদারি করা৷ এছাড়া, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির সদস্যদের নির্যাতন ও বিভিন্নভাবে হয়রানি করা৷ গেস্টাপো হাজার হাজার মানুষের নির্বাসন ও হত্যার জন্য দায়ী৷ নাৎসি ডকুমেন্টেশন সেন্টারের গাইড বলেন, ‘‘বন্দি থাকাকালীন জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে মারা গেছেন বলে মনে করা হয়৷ তাছাড়া শোনা যায়, যুদ্ধের শেষের দিকেও ইএল-ডিই-র এই বাড়িতেই কার্যকর করা হয়েছে একাধিক মৃত্যুদন্ড৷ তবে কোন সাক্ষ্য এবং বিশদ তথ্য না থাকায় এর সংখ্যা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়৷''
নাৎসি ডকুমেন্টেশন সেন্টারের অন্য তলাগুলোর প্রথম তলায় রয়েছে লাইব্রেরি এবং আলোচনা ও মিডিয়া প্রেজেন্টেশনের জন্য রয়েছে ইভেন্ট রুম৷ দ্বিতীয় তলা থেকে নাৎসি আমলে কোলোনের ইতিহাস সম্পর্কিত সব তথ্য প্রদর্শন করা হয়ে থাকে৷ লাইব্রেরিতে নাৎসি আমলের বিভিন্ন কাগজপত্র, খবরের কাগজের মূল কপি বা মাইক্রোফিল্ম, বই, স্কুলের টেক্স বই এবং ব্রোশিওর প্রভৃতি রয়েছে৷
নাৎসিদের ক্ষমতাগ্রহণ থেকে শুরু করে ১৯৪৫ সালে তাদের পতন পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই সংগ্রহশালায় রক্ষিত৷ ২০০৬ সালে ‘দ্য বেস্ট হেরিটেজ' পুরস্কার পাওয়া বিভিন্ন দেশের সংগ্রহশালাগুলির মধ্যে নাৎসি ডকুমেন্টেশন সেন্টারটিও অন্তর্ভুক্ত৷
প্রতিবেদন: আসফারা হক
সম্পাদনা: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়