1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারীরা কি নিজেদের মর্যাদা বোঝেন!

৯ এপ্রিল ২০২১

পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বেশিরভাগ নারীরাই যথাযোগ্য সম্মান বা মর্যাদা পান না৷ কিন্তু এজন্য কি পুরুষরাই কেবল দায়ী?

https://p.dw.com/p/3rnJg
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images

মায়ের প্রতি সম্মান, স্ত্রীর প্রতি সম্মান, কন্যার প্রতি সম্মান-একটি পরিবারে তিনটি প্রজন্মের প্রত্যেক নারী যদি যথাযোগ্য সম্মান পান তাহলে ওই পরিবারের ছোটরাও নারীকে সম্মান করতে শেখেন৷ কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিবারে নারীদের প্রতি শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তাচ্ছিল্য দেখা যায়৷ ‘মেয়ে ছেলে’দের নিয়ে এই ঝামেলা, মেয়েমানুষকে দিয়ে কিছু হবে না৷ আর কোন পরিবারের ছোট ছেলে মেয়েরা যখন মা বা দাদী বা ফুফুর সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য শুনে বড় হন তাদের মনেও নারীর প্রতি সম্মানের একটা ‘মানদণ্ড’ তৈরি হয়ে যায়৷

বাংলা সিনেমাতে নারীদের কীভাবে উপস্থাপন করা হয় বলুন? শাবানার আমলের সিনেমায় ভালো স্ত্রী সারাজীবন চোখের জল মুছতে মুছতে অন্যদের অন্যায় অপমান সহ্য করে যান, লাথি, ঝাঁটা খেয়েও স্বামীর আশ্রয়ে থাকতে চান৷ এর পরের প্রজন্মের বেশিরভাগ ছবিতে নায়িকা কেবল নাচ-গানের জন্য পর্দায় আসেন৷ কোন ছবিতে যদি (শাবনূর ও সালমান শাহ অভিনীত ছবি) নায়িকা স্কার্ট পরে ভার্সিটিতে আসেন প্রত্যেক ছাত্রের নজর থাকে সেই নায়িকার দিকে এবং নায়ককে দেখা যায় নায়িকাকে শালীন পোশাক এবং কথায় সংযত হতে বলতে৷ এ থেকে আপনি কি শিক্ষা পেলেন, নারীদের সব সময় কোমল, অবলা হয়ে থাকতে হবে৷ পুরুষ যে পোশাককে নারীর জন্য আদর্শ মনে করে সেই পোশাক পরতে হবে৷ এরকম হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে৷

গত বছর বাংলাভিশনের এক টক শোতে অভিনেতা অপূর্ব আর তার সাবেক স্ত্রী এসেছিলেন, যেখানে স্ত্রী চোখ নামিয়ে বলছিলেন অপূর্ব পছন্দ করেন না তিনি চাকরি করেন৷ আর কি অদ্ভূত ব্যাপার দেখুন অপূর্ব খুব অহংকার নিয়ে বললেন তার স্ত্রী সংসার সামলাবে, সন্তানের দেখাশোনা করবে এটাই তিনি চান, চাকরির কি দরকার৷ আমি খুব অবাক হয়ে দেখছিলাম, অপূর্বর উপস্থাপক বন্ধু মিথিলা এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলেন না৷ আমরা প্রায়ই আলোচনা করি নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে নারীর মর্যাদা দেয়া হয় না৷ এদের কি বলবেন!

এবার আসি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীর প্রসঙ্গে৷ ভীষণ সুন্দর শান্তশিষ্ট মেয়েটি প্রেমে পড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতার, পরবর্তীতে যিনি সাংবাদিকতায় বেশ নাম করেছেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করার আগেই তাদের বিয়ে হয়৷ প্রথম সন্তান হওয়ার পর হঠাৎ দেখি ফেসবুক থেকে মেয়েটি উধাও৷ পরে আমাদের এক বন্ধুর কাছে জানতে পারি, মেয়েটিকে নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন করেন সেই প্রেমিক স্বামী৷ মেয়েটি চাকরি করত না৷ বাইরে তেমন বের হত না৷ খুব ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুর কাছে ব্যাপারটা জানিয়েছিল৷ দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার পর স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার আমার সহপাঠীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল, ভর্তি করেছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা৷ কিন্তু অন্য আত্মীয় সমাজের কাছে নিজের সম্মানহানির ভয়ে মামলা বা অভিযোগ করতে রাজি হয়নি মেয়েটি৷ এ কেমন সম্মান ধরে রাখার চেষ্টা!

চাকরির সুবাদে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি৷ যখনই কোন মেয়ে ভালো কাজ করেছে, অন্য নারীদের দেখতাম সমালোচনা করতে৷ কীভাবে সে এত ভালো বিট পায়, কেমন করে এত ভালো রিপোর্ট করে এর পেছনে নানা তথ্য উপাত্ত হাজির করতো তারা, অথচ পুরুষ সহকর্মীর ব্যাপারে এটা খুব সাধারণ ছিল৷ অর্থাৎ আমরা নারীরাও যেন চাই না কোন মেয়ে তার যথাযোগ্য সম্মান পাক৷ কেউ একটু উপরে উঠে গেছে একশ' টা হাত টেনে তাকে নিচে নামাতে চায়৷

ধর্মীয় নেতাদের অনেকেই তাদের বক্তব্যে নারীদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেন৷ আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রয়াত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফির কথা৷ নারীদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘মহিলাদেরকে দেখলে দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়, বিবাহ করতে ইচ্ছা হয়৷ লাভ ম্যারেজ/কোর্ট ম্যারেজ করতে ইচ্ছা হয়৷’’ কি কুৎসিত, অশ্লীল মন্তব্য!

এবার আমাদের নারী নেত্রীদের কথায় আসি৷ আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিপক্ষ দলের নেত্রীর সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন নানা সময়ে তা কি নারীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করার জন্য যথেষ্ট নয়? শেখের বেটি, জিয়ার বউ অনেকে আমাদের নারী নেত্রীদের সম্পর্কে এভাবে অবজ্ঞা ভরে কথা বললেও তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে৷ আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার যেখানে নারী সেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজেই যখন এমন মন্তব্য করেন তখন পুরো দেশ, পুরো সমাজ কি শিক্ষা নেন তার কাছ থেকে৷

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে পুরনো উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘‘বিদেশে যাওয়ার পরে সে যখন শপিং করে তখন হুইল চেয়ারে শপিং করত, ফালু ঠেলত, আর সে গিয়ে শপিং করত৷ সে যখন হজ করে সেখানেও ফালু হুইল চেয়ার ঠেলে সে হজ করে৷ হুইল চেয়ারে বসা সেটা নতুন কিছু হয়৷ এটাতো বহু যুগ ধরে দেখে আসছি৷’’ (২০১৯, ৫ ডিসেম্বর)

লক্ষ্য করুন একসময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রীকে তিনি ‘আপনি’ সম্বোধনটুকু করেননি৷ আর যে ‘ফালু’র কথা বলেছেন তিনি মোসাদ্দেক আলী ফালু, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক রাজনৈতিক সচিব ছিলেন৷  এর আগে তিনি দীর্ঘদিন খালেদা জিয়ার সহকারী ছিলেন৷

অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলে
অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

ফালুকে জড়িয়ে এর আগেও মন্তব্য করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্য সফররত খালেদা জিয়া এক বক্তব্যে বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের ‘ভালো লোক’ ও ‘দেশপ্রেমিক’দেরও সঙ্গে নেবেন৷

খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যের সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিপ্পনি কেটে বলেছিলেন, ‘‘আওয়ামী লীগে প্রেমিক খুঁজে পেলেন? তাহলে, ফালুর কী হবে?’’ বলেই হেসে ফেলেন তিনি৷ (৪ অক্টোবর ২০১৫)

এই বক্তব্য কি একজন প্রধানমন্ত্রীর সাজে? যার কথা দেশের সর্বস্তরের মানুষ শোনেন, তার কি একটিবারের জন্যও মনে হয়নি একজন নারী সম্পর্কে তার এই অবমাননাকর মন্তব্য নারীর মর্যাদাকে কোথায় দাঁড় করাবে!

অনেকের অনেক কথা বললাম৷ এবার শেষ করবো নিজের কথা দিয়ে৷ হিন্দু সমাজে নারীদের নানা বিধিনিষেধ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়েছে৷ বাবা মারা গেলে ছেলে মুখে আগুন দেবে, ছেলে না থাকলে ভাইয়ের বা বোনের ছেলে৷ আমাদের পরিবারে এই প্রথা ভেঙেছিলেন আমার বাবা৷ মৃত্যুর আগে বলেছিলেন আমরা দুই বোন এই কাজটি করব৷ তখন আমার মায়ের বয়স ৩১ বা ৩২! আমার মা বললে হয়ত কেউ শুনত না৷ হিন্দু ধর্মে মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ পায় না৷ তাই বাবা মাকে সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন, নমিনি আমরা দুই বোন৷ এ নিয়ে তার ভাইয়ের সাথে প্রচণ্ড মতবিরোধ হয়েছিল৷ আমরা সেখান থেকেই শিখেছিলাম মেয়েরা সমান সম্মান পাওয়ার যোগ্য৷ এমনকি আমার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এর ব্যতিক্রম দেখিনি৷ আমার শ্বশুর গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে আলোচনা করলে ছেলেদের পাশাপাশি ছেলের স্ত্রীদেরও মতামত নিতেন৷ ডেকে পরামর্শ করতেন৷

তাই আবারও বলছি নারীদের সম্মান কেবল পুরুষদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, নারীদের নিজেদেরও অন্য নারীকে যথেষ্ট সম্মান দিতে হবে৷ মেয়ে বলেই সুযোগ পেয়েছে এসব বলা দয়া করে বন্ধ করুন৷ বাচ্চাদের সামনে কোন নারীকে নিয়ে কীভাবে কথা বলছেন খেয়াল করে বলুন৷ সন্তানের সামনে কখনো মা বা স্ত্রীকে হেয় করবেন না৷ ছেলের সামনে কখনো মেয়েকে খাটো করবেন না৷

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক অমৃতা পারভেজ৷
অমৃতা পারভেজ ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান