1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নারীর প্রতি সংঘবদ্ধ আক্রমণের কারণ

হারুন উর রশীদ স্বপন (ঢাকা)
১১ আগস্ট ২০২৩

নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীকে অবদমন, নারীকে তার প্রাপ্য না দেয়া এটা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েরই ঘটনা নয়৷ এটা সংঘবদ্ধ ভাবে করা হয়৷ সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, আক্রমণ বা চরিত্র হনন কীসের বহিঃপ্রকাশ?

https://p.dw.com/p/4V4um
(ফাইল ছবি)
(ফাইল ছবি)ছবি: Sazzad Hossain/DW

খুলনায় চারজন নারী ফুটবলারের ওপর হামলা হয়েছে তারা এক নারী ফুটবলারের ছবি ছড়িয়ে দেয়ার প্রতিবাদ করায়৷ এখানে বিষয় ছিলো নারীরা হাফ প্যান্ট ও জার্সি পরে ফুটবল খেলে এটা মানতে পারেনি কেউ কেউ কেউ৷ তাই ছবি ছড়িয়ে দিয়ে কটুক্তি করা হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত হামলা করা হয়েছে৷ হামলার পর পুলিশ ও প্রশাসন সক্রিয় হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷ একজন হামলাকারী আটকও হয়েছে৷ তবে এই নারীরা কেন খেলবে? কেন খেলার পোশাক পরবে এটা নিয়ে কিন্তু একটি গোষ্ঠীর সমালোচনার শেষ নেই৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা তৎপর৷ খুলনায় হামলা না হলে হয়তো ছবি ছড়িয়ে কটুক্তির ঘটনাটা আমাদের নজরেও আসত না৷

আমাদের মানসিকতায় সমস্যা আছে ৷ নারীর খেলবে এটা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ এর পিছনে ধর্ম যেমন আছে৷ আছে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি৷

আর এ কারণেই এখানে নারী ক্রিকেটার, ফুটবলার জাতীয় দলে বেতন বৈষম্যের শিকার৷ তাই সাফল্য বয়ে আনা নারী ক্রিকেটারদের ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছিলো লোকাল বাসে৷ পুরুষ ক্রিকেটাররা গিয়েছিলেন বিশেষ এসি বাসে৷

সংঘবদ্ধ আক্রমণ বহুমাত্রিক:

গত বছরের জানুয়ারি মাসের ঘটনা৷ মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার এক প্রবাসী তরুণী যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গিয়ে জিন্সের প্যান্ট, শার্ট আর ওভার কোট পরা একটি ছবি দেন ফেসবুকে৷ আর তাতেই ওই এলাকার কিছু লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে৷ প্রথমে তারা ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্য করে৷ এরপর এলাকায় সালিশ বসায়৷ সালিশে ওই তরুণীর কুলাউড়ায় অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের একঘরে করে রাখার ঘোষণা দেয়৷ আর এই সিদ্ধান্ত দেয় ওই এলাকার মসজিদ কমিটি৷ মসজিদ কমিটি তার পরিবারকে ওই পোস্ট দেয়ায় ক্ষমা চাইতে এবং পোস্টটি সরাতে বাধ্য করে ৷ শুধু তাই নয়, তারা এনিয়ে কোথাও অভিযোগ করবেন না বলে মুচলেকাও নেয়া হয়৷ পরে বিষয়টি প্রশাসনের কাছে গেলে মসজিদ কমিটি ক্ষমা চেয়ে রেহাই পায়৷

২০১৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে নারীদের ফসলের মাঠে ও ক্ষেতে খামারে না যাওয়ার জন্য ফতোয়া দেন স্থানীয় কল্যাণপুর মসজিদের ইমাম ও অনুসারী মুসল্লিরা ৷ আর তা মসজিদের মাইকে প্রচার করা হয়৷ তাদের দাবি ছিলো, নারীরা ফসলের মাঠে গিয়ে ফসল চুরি এবং কেউ কেউ অসামাজিক কাজ করে৷ পরে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হলে পুলিশ ওই ইমামকে আটক করে৷

২০১৫ সালে বগুড়ার শাহজাহানপুরে প্রবাসী এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে রাগের মাথায় তালাক বলায় গ্রাম্য মাতব্বররা প্রথমে ওই পরিবারটিকে ফতোয়া দিয়ে এক ঘরে করে রাখে এবং পরে হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করে৷ হিল্লা বিয়ের পর আবার টেলিফোনে তার স্বামীর সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়৷ ওই নারী এরপর থানায় মামলা করলে পুলিশ যারা ওই ফতোয়া দেন, তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেন৷

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গোপালগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে ছয় সদস্যের এক ধর্ষক দল৷ ওই ধর্ষকেরা বন্ধুর সাথে থাকা ওই ছাত্রীকে প্রথমে ইভ টিজিং করে৷ এর প্রতিবাদ জানালে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে৷

প্রচলিত নানা কারণের সঙ্গে এখন নতুন করে ধর্মীয় উগ্রবাদ যুক্ত হয়েছে: খুশী কবির

কেন এই সংঘবদ্ধ সহিংসতা:

নারীর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়৷ আর এই সহিংসতা ব্যাপ্তি বোঝা যায় তাদের প্রতি সংঘবদ্ধ আচরণে৷ মানবাধিকার কর্মী এবং নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন,"নারীর প্রতি ব্যক্তির যে আচরণ সেটা এই সংঘবদ্ধ আচরণ দিয়েই বোঝা যায়৷ আমাদের সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রে নারীকে হেয় করে দেখা বা ছোট করে দেখার প্রবণতা এখনো কমেছে বলে মনে হয় না৷ পুরুষরা মনে করে নারীরা তারা যেরকম বলবে সেই রকম চলবে৷ তার কোনো ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নাই৷ নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর খেলাধুলা, স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচন-এর কোনো কিছুই তাদের সহ্য হয় না৷”

তিনি বলেন,"এর সামাজিক বৈষম্যের যেমন রূপ আছে৷ তেমনি সহিংসতার মাধ্যমেও তা প্রকাশ পায়৷ সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, সংঘবদ্ধভাবে উত্যক্ত করা ওই বিকৃতিরই আরো বড় প্রকাশ৷ তারা মনে করে নারীদের প্রতি ওই আচরণ করলে তাদের কিছু হবে না৷ সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তারা এরকম ধারণাই পেয়েছে৷”

বিশ্লেষকেরা নারীর প্রতি শুধু সংঘবদ্ধ সহিংসতাই নয় নারীকে সংঘবদ্ধ ভাবে অবদমনের শিকার হওয়ার কথাও বলেন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী আন্দোলনে যুক্ত নারীদের কটুক্তি করা হয়৷ নানা অসত্য তথ্য প্রচার করা হয়৷ নারীবাদীদের হেয় করে আপত্তিকর কথা বলা হয়৷ শুধু তাই নয় নারী যারা রাজনীতিতে যুক্ত তারাও সংঘবদ্ধ সাইবার আক্রমণের শিকার হন৷ তাদের ছবি বিকৃত করে, কন্ঠ নকল করে অনেক অপপ্রচার করা হয়৷ বাংলাদেশের কয়েকজন তরুণ নারী রাজনৈতিক নেতা এই সংঘবব্ধ আক্রমণের শিকার৷

সমাজে উগ্রবাদ বাড়ছে:

নারী নেত্রী খুশী কবির মনে করেন,"প্রচলিত নানা কারণের সঙ্গে এখন নতুন করে ধর্মীয় উগ্রবাদ যুক্ত হয়েছে৷ এই বাংলাদেশেই এক সময় কে কী পোশাক পরত তা নিয়ে কেউ ভাবতো না৷ নারী নেত্রীদের, নারী আন্দোলনে যারা যুক্ত তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো৷ এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী মনে করে তারা যেরকম চায় সবকিছু সেরকম হতে হবে৷ তাদের মূল টার্গেট নারী৷ আর তারই প্রভাবে নারীরা সংঘদ্ধ আক্রমণ, হেনস্তার শিকার হচ্ছেন৷ তারা মনে করেন কেউ কপালে টিপ পরবে কী না, তা তারা ঠিক করে দেবেন৷ নারীরা ফুটবল খেলবে কী না তাও তারা ঠিক করে দেবেন৷”

তার কথা,"আমরা খেয়াল করি বা না করি রাষ্ট্রে ও সমাজে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা হলো এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচেছ না৷ তাদের প্রশ্রয়ও দেয়া হচ্ছে৷”

পরিবার ও রাষ্ট্রে নারীকে হেয় করে দেখার প্রবণতা কমেছে না: অ্যাডভোকেট এলিনা খান

সমাজের অস্থিরতা ও কুসংস্কার:

নারীর প্রতি সংবদ্ধ অপরাধ ও সহিংস আচরণের নেপথ্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাও কাজ করে৷ কাজ করে ধর্মীয় কুসংস্কার৷ আর সমাজে যে অস্থিরতা আছে তারও ও প্রকাশ ঘটে নারীর প্রতি সংঘবদ্ধ সহিংস আচরণে৷

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান মনে করেন,"নানা সামাজিক চাপ ও অস্থিরতার প্রকাশ ঘটে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের মাধ্যমে৷ নারী যেহেতু পরিবার, সমাজে দুর্বল অবস্থানে আছে তাই তার ওপর আক্রমণের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে৷ আর খুলনায় নারী ফুটবলারদের ওপর হামলার পিছনে আছে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার৷”

"এর ভিতরে রাজনীতিও আছে৷ রাজনৈতিক কারণেও নারী সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়৷ ক্ষমতার বিষয় আছে৷ আসলে এর সঙ্গে আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয়া উগ্রতা, তালেবানি মানসিকতা সব কিছু জড়িয়ে আছে”, বলেন এই মানবাধিকার কর্মী৷ তবে সবার উপরে বিচারহীনতা প্রধান কারণ বলে তিনি মনে করেন৷ তার কথা, "নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই এটা বাড়ছে৷ আর ব্যাক্তি যখন পার পায় তখন সংঘবদ্ধ গ্রুপ মনে করে এটা তো সহজ৷ তাই তারাও সংঘবদ্ধভাবে একই আচরণ করে৷ তারা নিজেদের শক্তিশালী মনে করে৷”

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম মনে করেন, "নারীরা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব সময় সংঘবদ্ধ আক্রমণ ও চাপের মুখে ছিলো৷ তাই নারী যখন এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন সম্মিলিতভাবে তার চরিত্র হনন করা হয়৷ নারীরা পরিবারের মধ্যেও সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার৷ ” তিনি বলেন,"নারীরা বাইরে খেলাধুলা করবে সেটা নিয়ে আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সব সময়ই একটা সমস্যা আছে৷ যদিও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন৷ তারপরও নারীরা ব্যাডমিন্টন খেলবে, ফুটবল খেলবে, ফুটবল বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হয়, স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে হয়-এটা নিয়ে কুসংস্কার সব সময়ই ছিলো৷ এ কিন্তু আমাদের সমাজ এবং পরিবারেও সমস্যা আছে৷”

তার কথা,"অনেক সংকটের মধ্যেও নারীদের বড় বড় অর্জন আছে৷ তাদের পাশে তাদের পরিবার আছে, অনেকেই আছেন৷ তারপর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো বদলাতে হবে৷ এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে৷ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ এটা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার কাজ নয়৷”