নারীর জন্য কতটা নিরাপদ কলকাতা ?
২৯ জুন ২০১৮নারীদের নিরাপত্তাহীনতা, যৌন অপরাধ, নারী পাচারের মতো ঘটনায় ভারতের স্থান বিশ্ব তালিকায় সবার শেষে৷ মেয়েদের জন্য সবথেকে বিপজ্জনক দেশ ভারতই৷ সিরিয়া, সোমালিয়া, সৌদি আরব, বা আফগানিস্তানের থেকেও মেয়েদের বিপদ বেশি ভারতে৷ এমনকি প্রতিবেশী পাকিস্তানও এই তালিকায় রয়েছে ছয় নম্বরে৷
থমসন-রয়টার্স ফাউন্ডেশন সংস্থার এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সোমবার৷ বৃহস্পতিবার ভারতের জাতীয় মহিলা কমিশন এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷ কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, ১৩০ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৫০০ জন মহিলাকে প্রশ্ন করে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পদ্ধতিই ভুল৷ ভারতে মহিলারা বরং নিজেদের আইনি অধিকার সম্পর্কে আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন৷ আইনের সাহায্য পাওয়ার সুযোগও ভারতীয় মহিলাদের এখন অনেক বেশি৷
ভারত সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকও রিপোর্টটি খারিজ করেছে তার পদ্ধতিগত গলদের কারণে৷ মন্ত্রকের বক্তব্য, যে ৫০০ জন মহিলার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, স্রেফ তাঁদের ধারণার ভিত্তিতেই ভারতকে মহিলাদের পক্ষে বিপজ্জনক দেশ বলে দাবি করা হয়েছে, কিন্তু তার সপক্ষে কোনও তথ্য-পরিসংখ্যান দেওয়া হয়নি৷
কিন্তু যে কোনও সময় যদি কয়েকজন মহিলার সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করা হয় তাঁরা কতটা নিরাপদ, তা হলে এর থেকে অন্যতর কোনও ছবি কিন্তু উঠে আসে না৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল একটি ছোটদের স্কুলের শিক্ষিকা সুপর্ণা মিত্রকে৷ আজন্ম কলকাতার বাসিন্দা সুপর্ণা মাঝে বছর দুয়েক মুম্বই শহরে কাটিয়েছেন৷ তিনি নারী সুরক্ষার প্রশ্নে কলকাতার থেকে মুম্বইকেই এগিয়ে রাখছেন৷
যে শহরে তাঁর বড় হয়ে ওঠা, সেই শহরেই এখন গণপরিবহণে যাতায়াত করাটা তাঁর কাছে ঘোর অস্বস্তিকর৷ জানালেন, অটো রিকশায় দু'জন পুরুষের মাঝখানে বসতে, ভিড় বাসে উঠতে তাঁর এখন রীতিমতো অস্বস্তি হয়৷ এবং সমস্যাটা কেবল রাস্তাঘাটে নয়৷ সুপর্ণার অভিজ্ঞতা, কে কী রকম জামাকাপড় পরছে, তাই থেকেও একজন মেয়ে সম্পর্কে ধারণা করে নেয় এই শহর৷
একই অভিজ্ঞতা শ্রাবণী খাঁ'র৷ আসানসোলের মেয়ে শ্রাবণী৷ ঝাড়খণ্ড সীমান্তের যে শিল্প-শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিশেষ সুনাম নেই৷ ওখানে রাত ৮টা-সাড়ে ৮টার মধ্যে সবাই বাড়ি ঢুকে যায়৷
কিন্তু কলকাতা শহরে পড়াশোনা এবং এখন চাকরির সূত্রে থাকতে গিয়েও কি অন্য কোনও অভিজ্ঞতা হচ্ছে শ্রাবণীর? না৷ প্রথমে কলকাতা এসে তিনি যে এলাকায় থাকতেন, সেখানে একটি স্কুলের ছেলেদের আচরণ থেকেই তাঁর বরং বোঝা হয়ে গিয়েছিল, কোন শিক্ষা নিয়ে বড় হচ্ছে ওই ছেলের দল৷ ভবিষ্যতে মেয়েদের প্রতি আচরণই বা তাদের কেমন হবে৷
এখন এক এফ এম রেডিও চ্যানেলের আরজে শ্রাবণী চাকরি করতে রোজ পার্ক স্ট্রিটে যান৷ সেখানে কোনও অসুবিধের মধ্যে পড়তে না হলেও, একটু বেশি রাতে টালিগঞ্জে নিজের বাড়ি ফিরতে ট্যাক্সিতে রীতিমতো আতঙ্কে থাকেন তিনি, কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁর ভালো নয়৷
তবে গোটা সমস্যাটার ওপর একটা অন্যরকম আলো ফেললেন পেশায় চিকিৎসক মৌমিতা৷ কলকাতার মেয়ে মৌমিতা ডাক্তারি পড়েছেন নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে, থেকেছেন শিলিগুড়িতে৷ আর এখন থাকেন কলকাতায়৷
চেম্বার সেরে ফিরতে তাঁর প্রায়শই রাত হয়৷ মৌমিতা বলছেন, প্রথমত নিরাপত্তা না থাকার অভিজ্ঞতা উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়েদের থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের অনেকটাই আলাদা৷ বিশেষত যাঁরা ঝুপড়ি ঘরে, বা বস্তিতে থাকেন৷ তার পরেই নিজেকে নিরাপদ রাখাটা অনেক ক্ষেত্রেই একজন মানুষের নিজস্ব জোর, মানসিক বা শারীরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে৷
কিন্তু মৌমিতার প্রশ্ন, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে সমস্যাটাকে এভাবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? মেয়েরা ধর্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে? তা হলে ধর্ষণকেই বা এভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে কেন? ধর্ষণ যদি শারীরিক নিগ্রহ হিসেবে ধরে নিতে হয়, তা হলে একজন পুরুষের প্রাণহানির সম্ভাবনা, শারীরিক জখমের সম্ভাবনা তো একই রকম বিপজ্জনক! এবং সে হিসেবে দেখতে গেলে, কোনও প্রাণীই তো নিরাপদ নয়৷ আলাদা করে মেয়েদের বিপদের কথা তোলার অর্থ কী!