নারী মুক্তিযুদ্ধা
৪ এপ্রিল ২০১২‘‘আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে পার হলাম সেসময় আমাদের জন্য খুবই দুঃসময় ছিল৷ সেসময় প্রতিদিনই যে হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পার হয়ে ওপারে যেত, তাদের সাথে কিশোরী এবং যুবতী মেয়েরাও সীমান্ত পেরিয়ে গেছে৷ কিন্তু তখন গ্রাম-মহল্লার মধ্য দিয়ে যাওয়া যে কী কষ্টের ছিল, কীভাবে রাত-বিরাতে অজানা-অচেনা মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে, রাত কাটাতে হয়েছে, কতোটা বিপদ শঙ্কা আর ঝুঁকির মধ্য দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম - তা মনে করে এখনও আমি শিহরিত হই৷ অথচ দেশ স্বাধীনের চল্লিশ বছরে দেশের পরিস্থিতির এতো অবক্ষয় হয়েছে যে, আমার আশঙ্কা এখন যদি আবারও কোন কারণে আমার দেশের মানুষকে, নারীদেরকে সেভাবে পালাতে হয়, তাহলে মা-বোনদের ইজ্জত, মান-সম্মান রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়বে৷ কিন্তু তখন মানুষ আমাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, নারী হিসেবে যে সম্মানের সাথে সীমান্ত পার করে দিয়েছিল আমি সেই স্মৃতি কখনই ভুলবো না৷'' এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছিলেন বীর সাহসী মুক্তিযোদ্ধা রাফিয়া আক্তার ডলি৷
দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের নারী সমাজ কীভাবে মাঠে-ময়দানে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিলেন তা দেখে ভারতের মানুষও খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা ডলি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘কলকাতার মাঠে-মাঠে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে আমরা যে সভা-সমিতি করতাম, আমি ভুলবো না যে তখন সেখানকার মানুষ ভাবতেই পারতো না যে বাংলাদেশের কোন নারী এসে এভাবে পাড়ায় পাড়ায় বৈঠক-সভা করবে৷ এছাড়া বক্তৃতা করে মানুষকে এতো উদ্বুদ্ধ করতাম যে, মানুষ জিজ্ঞেস করতো, এরা কি সত্যিই বাংলাদেশ থেকে এসেছে? এতোটাই তারা অভিভূত হতো যে, জিজ্ঞেস করতো, এরা কি সত্যিই বাংলাদেশের মেয়ে?''
৮ই ডিসেম্বর যশোর এলাকা যখন মুক্ত হয়ে যায়, তখন যশোরে এসে কিছু কর্মসূচিতে অংশ নেন নারী নেত্রী রাফিয়া আক্তার৷ এরপর ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় হলে স্বাধীন-মুক্ত দেশে ফেরার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেন৷ কিন্তু পাসপোর্ট, ভিসা, টিকেট ছাড়া কীভাবে দেশে ফিরবেন? এ অবস্থায় ২২শে ডিসেম্বর ত্রাণবাহী বিমানে করে ঢাকায় আসেন ডলি এবং তাঁর সঙ্গীরা৷ সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে তিনি আবারও দেশ গড়ার কাজ, বিশেষ করে অসহায় নারীদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন রাফিয়া আক্তার ডলি৷
তাঁর এ সময়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘দেশে ফিরে দেখলাম পরিচিত-অপরিচিত অসংখ্য অসহায় নারীর করুণ অবস্থা৷ অনেকের পিতা, অনেকের স্বামী, অনেকের ভাই কিংবা সন্তান যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি৷ এসব অসহায় নারীদের প্রথমে সংগঠিত করি৷ আমরা যারা নারী সাংসদ ছিলাম, তারা এসব নারীকে একত্রিত করে দুঃস্থ মহিলা সংস্থা নামে একটি সংগঠন তৈরি করি৷ নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আমরা তখন থেকেই কাজ শুরু করি৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গিয়ে তাঁর সহযোগিতায় আমরা এ সংস্থাটি দাঁড় করায়৷ পরে এ সংস্থাটি মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে একীভূত হয়ে গেছে৷ ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য হই৷ এসময় আমি সংসদের হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করি৷ এছাড়া দেশের প্রথম সংসদের সদস্য হিসেবে সংবিধান তৈরির জন্য আমাদেরকে বেশি সময় ও শ্রম দিতে হয়েছে৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে শহিদ হলেন তখন সেটা আমাকে খুব নাড়া দেয়৷ আমার কাছে মনে হলো, যে জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু সারাজীবন জেল-জুলুম খেটেছেন এবং দরকার হলে নিজের রক্ত দিয়েও দেশ স্বাধীন করতে যিনি প্রস্তুত ছিলেন, সেই মহান নেতাকে যখন দেশের মানুষ মেরে ফেলল, তখন এ জাতির কাছে আর কী আশা করা যায়? এমন এক অনুভূতি থেকে আমি ধীরে ধীরে রাজনীতির মূল ধারা থেকে সরে আসি৷''
তবে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালেও সমাজ সেবা ও নারী আন্দোলন থেকে একটুও পিছপা হননি সংগ্রামী নারী রাফিয়া আক্তার ডলি৷ নারী অধিকার ও নারীর উন্নয়নে আন্দোলনরত নেত্রী রাফিয়া আক্তার বর্তমানে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ