নারী মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়নের দাবি ফরিদার
২৬ জুলাই ২০১১তবে এখনও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় কষ্ট রয়েছে তাঁর৷ ১৯৪৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীতে জন্ম ফরিদা খানম সাকীর৷ মা লুৎফুন নাহার বেগম এবং বাবা আবদুল আলীম৷ তাঁর নানা উকিল সেকান্দার মিয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন৷ মামা শাহাব উদ্দিন ইস্কান্দার কচি এমসিএ ছিলেন৷ মামীও ছিলেন সাংসদ৷ এমন রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়ায় ছোট্ট থেকেই আন্দোলন আর সংগ্রামের ছোঁয়া পেয়েছেন তিনি৷
১৯৬৫ সালে নোয়াখালী কলেজে ভর্তির পর থেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত৷ '৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হন৷ সেই থেকেই দেশের প্রতিটি আন্দোলনে মিছিল মিটিংয়ে সরব উপস্থিতি ফরিদার৷ তখন থেকেই যুদ্ধের জন্য মানসিক প্রস্তুতি শুরু৷ ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আয়োজিত যুদ্ধের প্রশিক্ষণে অংশ নেন৷ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীর চর্চা কেন্দ্রে৷ মার্চের উত্তাল দিনগুলোতেও আন্দোলনে সক্রিয়তার স্বার্থেই বাড়িতে না থেকে রোকেয়া হলে অবস্থান করতেন ফরিদা এবং তাঁর সহকর্মীরা৷
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা যখন হল আক্রমণ করে, তখন তাঁরা আশ্রয় নেন হাউস টিউটরের বাসায়৷ সেই ঘটনা সম্পর্কে ফরিদা জানান, ‘‘ঐ বাসার একটা স্টোররুমে সাত আটজন মেয়ে সারা রাত কাটিয়েছিলাম৷ ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলে ছাত্রলীগের নেতারা রোকেয়া হলে আমাদের খোঁজে যান৷ তাঁদের ধারণা ছিল, হয়তো আমরা কেউ বেঁচে নেই৷ কিন্তু পথেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়৷ দেখে সবাই খুব অবাক হয়েছিলেন সেদিন৷''
এপ্রিলের শুরু থেকে নোয়াখালীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করতে থাকেন৷ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারত পাঠানোর কাজ করেন৷ তাঁদের জন্য টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় সংগ্রহ করতেন ফরিদা এবং তাঁর সহযোগীরা৷ পাকিস্তানি বাহিনী এপ্রিলের শেষে মাইজদীতে ঢোকে৷ প্রথমেই ফরিদার নানাবাড়ি পুড়িয়ে দেয়৷ সেখানে থাকতে না পেরে নানার গ্রামের বাড়ি কাদিরপুরে চলে যান৷ সেটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি৷ ফরিদার কাজ ছিল খবরাখবর আদান প্রদান করা৷ পাকিস্তানি সেনারা তাঁর মামাকে মেরে ফেলেন৷ এরপর রাজাকারদের অত্যাচারে আর সেখানে থাকতে পারেননি তিনি৷
এরপরই আ স ম আব্দুর রব এর চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী ছোট বোন শিরিন জাহান দিলরুবা এবং ছোট ভাই তাহের জামিলকে নিয়ে ভারত রওনা হন৷ ফেনীর বিলোনিয়া হয়ে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগরতলা পৌঁছান৷ লেম্বুছড়া শিবিরে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন ফরিদা৷ প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অপারেশনে যেতেন৷ ফরিদা এবং অন্যান্য নারী সহকর্মীদের কাজ ছিল রেকি করা৷ রেকি করে খবর নিতেন৷ এসব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছাতেন৷ এরপর সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন আগস্টের শেষ দিকে৷
তিনি সম্মুখযুদ্ধের একটি ঘটনা তুলে ধরলেন ডয়চে ভেলের কাছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা সেনবাগের কাছে গিয়েছিলাম৷ ঠিক সন্ধ্যায় সেনবাগের কাছাকাছি আসার পর আমরা পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি পড়ে যাই৷ তারাই আমাদের ওপর প্রথম গুলি ছোঁড়ে৷ আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ি৷ গোলাগুলি শুরু হয়৷ আমি আর আমার বোন গ্রেনেড ছুঁড়ে মারি৷ ওই যুদ্ধে আটজন পাকিস্তানি সেনা ও চারজন রাজাকার মারা পড়েছিল৷ বাকিরা পালিয়ে যায়৷ তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রগুলো আমরা কুড়িয়ে নিই৷'' এছাড়া তাঁর মা কীভাবে মাটির নিচে ছোট্ট বোনটিকে লুকিয়ে রাখতেন পাক সেনা এবং রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচাতে সেই গল্প বললেন ফরিদা৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ৷ এ সংসদের যুগ্ম সম্পাদক তিনি৷ এছাড়া জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালনা পরিষদের ও মহিলা সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য৷ নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে তেমনভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কখনোই৷ এখনো পুরোপুরি দেওয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগ বীর সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা খানম সাকীর৷ এছাড়া নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর প্রত্যাশা, ‘‘তারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে, মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস নয়, বরং সঠিক ইতিহাস জানবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করবে এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন