ভারতে আজও নরবলি দেয়া হচ্ছে
১২ মার্চ ২০১৭একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র, জলপড়া বা তান্ত্রিকদের দাপট চলছে দিব্যি৷ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই কুসংস্কারের বলি হচ্ছে অনেক জীবন৷ সহজ নিশানা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাবালক-নাবালিকারা৷ এই তো ১লা মার্চেও ভারতের কর্নাটক রাজ্যের এক মফঃস্বল শহরে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ১০ বছরের আয়েষাকে অপহরণ করে বলি দেওয়া হয়৷ আর এই বলি দেয় মেয়েটির নিকট পরিজনেরাই৷
কেন বলি দিয়েছে? এতে করে নাকি মেয়েটির এক অসুস্থ আত্মীয় সুস্থ হয়ে উঠবে৷ ৩রা মার্চ আয়েষার মৃতদেহ উদ্ধারের পর, পুলিশের বয়ানে এমনটাই বলা হয়৷ রামান্নাগ্রামের জেলা পুলিশ এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডের তদন্তসূত্রে গ্রেপ্তার করেছে চারজনকে৷ এরমধ্যে আছেন আয়েষার মামা মহম্মদ ওয়াসিম, যিনি স্থানীয় মসজিদের সেক্রেটারি৷ এছাড়াও আছেন রশিদুন্নেসা, নাসিম তাজ ও ১৭ বছরের এক কিশোর৷
ওয়াসিমের ভাই মহম্মদ রফিক প্যারালেটিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী৷ ভালো হবার আশা নেই৷ এই অবস্থায় নাসিম তাজ নিদান দেয় যে, রফিকের দেহে ভর করেছে প্রেতাত্মা৷ কম বয়সি একটি মেয়েকে বলি দিলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে এবং সেটা করতে হবে ৪০ দিনের মধ্যে৷ এতে প্রভাবিত হয়ে ওয়াসিম নিশানা করে আয়েষাকে৷ আয়েষার ফটো তুলে সে পাঠায় নাসিম তাজের অনুমোদনের জন্য৷
এরপর একদিন আয়েষা যখন তার বাবার দোকান থেকে বাড়ি ফিরছিল, তখন তাকে অপহরণ করা হয়৷ মুখে কাপড় গুঁজে প্লাস্টিকের টেপ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় তার মুখ৷ কাছের একটা গম্বুজের ভেতরে নিয়ে গিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয় তাকে৷ পরে মৃতদেহ বস্তাবন্দি করে দূরে ফেলে দেওয়া হয়৷
পুলিশ আয়েষার মৃতদেহ ছাড়াও বস্তার মধ্যে পায় ঝড়ফুঁক ও ব্ল্যাক ম্যাজিকের উপকরণ৷ পুলিশ ওয়াসিমের কল রেকর্ড চেক করার পর জেরার মুখে ওয়াসিম অপরাধের কথা স্বীকার করে৷ বাড়ির লোকজন যখন আয়েষার খোজাখুঁজি শুরু করে, তখন ভালো মানুষ সেজে ওয়াসিম তাঁদের সঙ্গ দেয়৷ আয়েষা যাতে নিরাপদে ঘরে ফেরে তার জন্য স্থানীয় মসজিদে দোয়াও করে ওয়াসিম৷ এই নৃশংস ঘটনা চাউর হলে পাড়াপড়শিরা ওয়াসিমের বাড়ির ওপর চড়াও হয়, চালায় ভাঙচুর৷ এবং অবিলম্বে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করে৷
এই নরবলি প্রথা শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ছিল৷ তবে অতীতে৷ প্রাচীন গ্রিসে দেবতা জিউসের সামনে শিশুবলি দেবার প্রমাণ পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা৷ খরস্রোতা নদীর ওপর বাঁধ ও সেতু নির্মাণের আগে কিংবা ঘরবাড়ি তৈরির আগে অশুভশক্তিকে তুষ্ট করতে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল জাপানে৷ মিশরে ফারাওদের কবরের সঙ্গে বেশ কিছু ক্রীতদাসকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হতো৷ দক্ষিণ এশিয়াতেও বড় বড় রাজা-মহারাজা বা জমিদারেরা বিশেষ কামনা পূরণের জন্য নরবলি দিত৷ নরমুণ্ড মালিনী, জিবে রক্তধারা, হাতে খাঁড়া নিয়ে দেবি কালীর বা দেবি চামুন্ডার বিগ্রহে অথবা বেদীতে নরবলি ছিল মর্যাদার প্রতীক৷ কালক্রমে এ প্রথাই মোষবলিতে বা পাঁঠা বলিতে নেমে আসে৷ হিন্দু পুরাণেও অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো নরমেধ যজ্ঞের উল্লেখ আছে৷ কিন্তু এই একবিংশ শতকেও নরবলি?
যুক্তিবাদীরা মনে করেন, এর বড় কারণ অশিক্ষা আর দারিদ্র৷ অন্ধবিশ্বাসে চালিত হয়ে এরা ভাগ্যের ওপর সব কিছু ছেড়ে দেয়৷ আর সেই সুযোগটাই নেয় তান্ত্রিকরা৷ নানা রকমের ঝাড়ফুঁক, কবজ-তাবিজ, পশুবলি, এমনকি নরবলি কিংবা শিশুবলি দিয়ে ভাগ্য ফেরাবার অথবা গুপ্তধন পাবার পরামর্শ দিয়ে থাকে তারা৷ এটা এখনও চলছে৷ পুলিশ প্রশাসন এটা বন্ধ করতে তেমন গা করছে না৷ পশ্চিম উত্তর প্রদেশেও গত চারমাসে বেসরকারি হিসেবে ২৮টি নরবলি বা শিশুবলির ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় এক সংবাদপত্র সূত্রে জানা গাছে৷
এ বিষয়ে মহারাষ্ট্র মন্ত্রিসভা এক অধ্যাদেশ জারি করে সম্প্রতি৷ এতে নিষিদ্ধ করা হয় মানুষকে শারীরিক এবং আর্থিক ক্ষতি করে এমন সব ব্ল্যাক ম্যাজিক ও আঘোরি প্রথা৷ এর আগে নরবলি এবং ঐ ধরনের কুপ্রথা রোধে একটি বিল আনা হয়েছিল, যেটা ঝুলেছিল গত ১৮ বছর ধরে৷ আইন হতে পারেনি বিধায়কদের দোনামনায়৷ কিন্তু কেন? পাছে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির উষ্মার কারণ হয়৷ বিজেপি ও মৌলবাদী শিবসেনার মতে, বিলে স্রেফ হিন্দুদের নিশানা করা হয়েছে৷ তাই এর বিরোধিতা করেছেন হিন্দু ধর্মীয়গুরুরা৷ এতে নাকি তাঁদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে৷ নেতা-মন্ত্রীদেরও যে ভিন্ন ভিন্ন গুরু আছে!
মহারাষ্ট্র সরকার অবশ্য নড়েচড়ে বসে যুক্তিবাদী নরেন্দ্র দাভলকরের হত্যাকাণ্ডের পর৷ দাভলকর এই বিল পাশ করার দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছিলেন৷ রাজ্যপালের সইয়ের পর এই অধ্যাদেশে কার্যকর হয়৷ অধ্যাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ১২টি কুসংস্কার-ভিত্তিক অন্ধপ্রথা৷ যেমন দুষ্ট আত্মা ভর করার বিশ্বাস, চলতি কথায় যার অর্থ ভূত তাড়ানোর নামে নানা ধরনের দৈহিক পীড়ন৷ এছাড়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে প্রথার নামে যৌন লালসা মেটানো, মলমূত্র খাওয়ানো ইত্যাদি৷ নিষিদ্ধ হয়েছে ফিটের ব্যামো বা মানসিক অসুস্থতায় ডাক্তারি চিকিত্সায় বাধা দিয়ে ওঝা ও গুণিনদের পয়সা রোজগারের ধান্দা এবং অবশ্যই নরবলি৷ এইসব বিধিনিষেধ অমান্য করলে ছ'মাস থেকে সাতবছর পর্যন্ত জেল এবং পাঁচ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে৷ তবে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যক্তির দৈহিক বা আর্থিক ক্ষতি হবে না, সেইসব এই অধ্যাদেশের আওতায় আসবে না৷
ভারতে আজও নরবলি হয় – এ কথা কি আপনার বিশ্বাস হয়? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷