নতুন বছরে সংখ্যালঘুদের 'সামান্য' চাওয়া
১ জানুয়ারি ২০২১গত ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ছাত্র ফোরামের এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও এমপিরা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর-জমি দখল করছে৷' এটাকে অবশ্য হাস্যকর অভিযোগ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আল হানিফ৷ তবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য দায়ী করেছেন, ‘অন্ধকারের শক্তি ও সরকারে থাকা অপশক্তিকে'৷
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ২০২০ সালের সাত মাসের সংখ্যালঘু নির্যাতনের তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তাতে বলা হয় মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর এই সাত মাসে ৬০টি পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করা হয়েছে৷ মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ২৩টি ঘটনা ঘটেছে৷ ওই সময়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ১৭ জন সংখ্যালঘু৷ হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ১১ জনকে৷ ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩০ জন৷ অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৩ জন৷
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৭টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে৷ বসতভিটা, জমিজমা, শ্মশান থেকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ২৬ টি৷ সাতজনকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে চারজনকে৷ বসত-ভিটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৮৮টি৷ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন ২৪৭ জন৷
চলতি জানুয়ারি মাসেই তারা গত বছরের পুরো ১২ মাসের সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরবে বলে জানান পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত৷
তিনি জানান ২০২০ সালের সাত মাসে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং মাইনরিটি ওয়াচ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া৷ তিনি বলেন, ‘‘তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিটি ঘটনা ক্রস চেক করি৷ আমাদের জেলা উপজেলা পর্যায়ে কমিটি আছে, তাদের এই ক্রস চেকের দায়িত্ব দেই৷ নিশ্চিত না হয়ে আমরা কোনো তথ্য প্রকাশ করি না৷''
‘অন্ধকারের শক্তি' এবং সরকারে থাকা ‘অপশক্তি' কারা?
হামলা, নির্যাতন, সম্পত্তি দখল ইত্যাদির সঙ্গে জড়িতদের দলীয় পরিচয় কী জানতে চাইলে রানা দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘গত ১১ বছরের ট্রেন্ড হলো অন্ধকারের শক্তি এবং সরকারে থাকা একটি অপশক্তি যৌথভাবে হামলা চালাচ্ছে৷ আমরা সরকারকে বললেই তারা আওয়ামী লীগে হাইব্রিড, কাউয়া, অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলে৷ কিন্তু তাদের তো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না৷''
২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন হয়৷ কমিশনের কাছে ১৫ হাজার অভিযোগ জমা হয়েছিল৷ তার মধ্যে পাঁচ হাজার ঘটনা তদন্ত করে ২০১১ সালে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের কাছে রিপোর্ট দিয়েছিল কমিশন৷ কিন্ত সেই রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি৷ সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে সংখ্যালঘু নির্যাতনে কারা জড়িত, কাদের কী স্বার্থ সব প্রকাশ হতো বলে মনে করেন রানা দাসগুপ্ত৷
‘কোনো সময়ই সংখ্যালঘু নির্যাতন গ্রহণযোগ্য নয়'
গত ২৫ ডিসেম্বরের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বিএনপি নেতা শামা ওবায়েদ শুক্রবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটা পারসেপশন তৈরি করে যে, তারা যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সংখ্যালঘুরা ভালো থাকে আর বিএনপি যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকে তখন তারা ভালো থাকে না, তখন তাদের ওপর অত্যাচার হয়৷ তারা একেবারে ভুল পারসেপশন তৈরির চেষ্টা করছে৷''
তিনি তার এলাকা বৃহত্তর ফরিদপুরের কথা উল্লেখ করে দাবি করেন, ‘‘ওই এলাকায় সংখ্যালঘু অনেকের জমিজমা, ঘরবাড়ি দখল করে নিচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা৷ এমপিদের প্ররোচনায় স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বাররা এসব করছেন৷ কারণ, তারা ধরেই নেয় এরা আমাদের ছেড়ে যাবে কোথায়৷ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রিপোর্টগুলোতেও তার প্রমাণ মিলবে৷''
শামা ওবায়েদ আরো দাবি করেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সব ধর্মের মানুষের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করবে৷ সংখ্যালগুরা যাতে কোনো নির্যাতন, অন্যায় আচণের শিকার না হয় তারা ব্যবস্থা নেবেন দাবি করে শামা ওবায়েদ বলেন, ‘‘বিএনপি সাম্যে বিশ্বাস করে৷''
তাহলে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় কার? শামা ওবায়েদ বলেন, ‘‘তখন যদি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে যেখানে ঘটেছে সেখানে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের দায় নিতে হবে৷ আমি তো বলছি না আমার দল সব ঠিক করেছে৷ কোনো সময়ই সংখ্যালঘু নির্যাতন হওয়া উচিত না, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক৷''
‘এখন বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে'
শামা ওবায়েদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আল হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর চেয়ে আর কোনো হাস্যকর অভিযোগ নাই৷ বিএনপির আসলে কোনো আদর্শ নাই৷ বিশেষ করে তারেক জিয়া নেতৃত্বে আসার পর তারা হত্যার রাজনীতি শুরু করেছে৷ ২০০১ সালে তারা আওয়ামী লীগের ২৫ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে৷ ২০০৪ সালের ২১ আগষ্টসহ একাধিকবার তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে৷ এখন তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উদ্ভট কথা বলছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘২০০১ সালের নির্বাচনের পর ভোলায় ১০ হাজার সংখ্যালঘুকে নির্যাতন করে ঘরছাড়া করেছে বিএনপি৷ তখন সারাদেশে লাখ লাখ সংখ্যালঘু তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ বিএনপি-জামাত স্বাধীনতার মূল নীতিতে বিশ্বাস করে না৷ তারা জানে, সংখ্যালঘুদের সাথে আওয়ামী লীগের একটা আত্মার সম্পর্ক৷ তাই সংখ্যালঘুদের প্রতিপক্ষ মনে করে নির্যাতন-নিপীড়ণ করে৷ ক্ষমতায় থাকলেও করে, ক্ষমতার বাইরে থাকলেও করে৷''
কিন্তু এখন তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘‘বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে৷ সামাজিক, পারিবারিক ও স্থানীয় কারণেও হচেছ৷ কিন্তু সরকার যখনই ঘটনা ঘটছে, তখনই ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ তাদের সুরকক্ষার ব্যবস্থা করছে৷ শুধু সংখ্যালঘু কেন, দেশের সব নাগরিকের সুরক্ষার দিকেই সরকারের নজর আছে৷''
তার মতে, ‘‘পার্থক্য হলো বিএনপি দলীয়ভাবে অথবা যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সরকারিভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন চালায়৷ তারা নির্যাতনে সমর্থন দেয়, উৎসাহিত করে৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ এর বিরুদ্ধে৷ আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়৷''