পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দুর্নীতি
২১ ডিসেম্বর ২০১৬ভারতের যেখানেই পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী বা সেনাকে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের নামে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানেই সেই অতিরিক্ত ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে৷ সে কাশ্মীর হোক বা উত্তর-পূর্ব ভারত, সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী সুরক্ষা দেওয়ার বদলে সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও বেশি অনিরাপদ করে তোলে প্রায়শই৷ আর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, যেখানে আইন-শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ার আশু কোনো সম্ভাবনা নেই, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা নেই, সেখানেই পুলিশ সর্বতোভাবে তৎপর স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত করেও আইনের অপশাসন কায়েম করতো৷
একটি ছোট ঘটনা৷ বারাসতের ফল ব্যবসায়ী ইউনুস আলি মন্ডল তাঁর দাদার হাত দিয়ে ঝাড়খন্ডের ১২ জন ফল ব্যবসায়ীর কাছে ৪৫ লক্ষ টাকা পাঠাচ্ছিলেন৷ যে গাড়িতে সেই টাকা ঝাড়গ্রাম যাচ্ছিল, সেটি গভীর রাতে খড়গপুর থানা এলাকায় একটি গাড়িকে ধাক্কা মারে৷ নিছকই পথ দুর্ঘটনা৷ পুলিশ নিয়ম অনুযায়ী, দু'টি গাড়িকেই আটক করে এবং সেই সঙ্গে ঐ ৪৫ লক্ষ টাকা ভর্তি দু'টি ব্যাগও বাজেয়াপ্ত করে৷ যদিও আইন অনুযায়ী, এই টাকার সঙ্গে ঐ পথ দুর্ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই৷ পুলিশ নিয়মমাফিক দুই গাড়ির মালিক এবং চালকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে, তার বেশি কিছু নয়৷
কিন্তু ফল ব্যবসায়ী ইউনুস মন্ডল সেই টাকা উদ্ধার করতে পারেন না৷ যতবার তিনি পুলিশের কাছে তদ্বির করতে যান, ততবার তাঁকে এ থানা থেকে ঐ থানা, পুলিশের এক আধিকারিক থেকে অন্য আধিকারিকের কাছে ঠেলে পাঠানো হয়৷ সব জায়গায় যান ইউনুস মন্ডল, জানান, ব্যবসা চালু রাখতে গেলে ঐ টাকাটা ফেরত পাওয়া তাঁর দরকার, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না৷ শেষে, সুবিচারের আশায় খড়গপুর যে জেলায়, সেই পশ্চিম মেদিনীপুরের খোদ পুলিস সুপার ভারতী ঘোষের দ্বারস্থ হন ইউনুস মন্ডল৷ কিন্তু তাতেও তাঁর সমস্যার সুরাহা তো হয়ই না, বরং তাঁর অভিযোগ, তাঁকে বলা হয়, সেই ৪৫ লক্ষ টাকার উৎস জানতে বিস্তারিত তদন্ত করবে পুলিশ এবং তাতে বিস্তর সময় লাগবে৷ ইউনুস মন্ডল এই প্রশাসনিক বক্তব্যের সারবত্তা মানতে নারাজ থাকায় তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়, বেশি বাড়াবাড়ি করলে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচার এবং নিষিদ্ধ মাদকের চোরা কারবারের কেস দিয়ে দেওয়া হবে তাঁকে৷ অভিযোগ, স্বয়ং পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষই নাকি তাঁকে এই অন্যায় হুমকি দেন!
কিন্তু ইউনুস মন্ডল হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না৷ তিনি প্রথমে উচ্চতর প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ রাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান সচিব এবং রাজ্য পুলিসের ডিরেক্টর জেনারেলের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন৷ তাতেও কিছু না হওয়ায় সরাসরি কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছেন ইউনুস মন্ডল৷ বিষয়টি এখন আদালতের বিচারাধীন এবং রাজ্য সরকারের কাছে এ ব্যাপারে কৈফিয়ৎ তলব করেছে কলকাতা হাইকোর্ট৷ অন্যদিকে মেদিনীপুর জেলা পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ঐ ফল ব্যবসায়ী মূলত চোরা কারবারি এবং তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ নাকি আগে থেকেই আছে৷ পুলিশের এই দাবি যদি সত্যি হয়, তা হলে বলতেই হয়, একজন দাগী চোরা কারবারির পক্ষে এভাবে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রশাসন এবং বিচারবিভাগের দ্বারস্থ হওয়া রীতিমত অভিনব এবং সম্ভবত বেনজির৷ যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয় যে ইউনুস মন্ডল আদতেই অসৎ এবং অবৈধ কাজে জড়িত, তা হলে তাঁর পক্ষে এমন সৎসাহস দেখানো নেহাত সোজা কথা নয়৷ নিজের টাকা ফেরত পেতে তিনি সবসময়ই আইনের মধ্যে থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এটাও লক্ষ্যণীয়৷
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আদালতের হাতে৷ রাজ্য সরকার কী অবস্থান নেয়, সেটাও দেখার৷ বিশেষ করে নোট বাতিল পরবর্তী টাকার আকালে একজন ফল ব্যবসায়ীর ৪৫ লক্ষ টাকা আটকে রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত এবং ন্যায়সঙ্গত, সেটা কতটা সাধারণ মানুষের স্বার্থে, সেটাও দেখার৷ অবশ্য ইউনুস মন্ডলকে যদি একজন খেটে খাওয়া ব্যবসায়ী হিসেবে রাজ্য সরকার মেনে নেয়, তবেই এ প্রসঙ্গ ওঠে৷ প্রসঙ্গত, পশ্চিম মেদিনীপুরের সুপার ভারতী ঘোষ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অত্যন্ত প্রিয়পাত্রী৷ বিশেষত মাওবাদী অধ্যুষিত বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলে জঙ্গি শাসনে ভারতী ঘোষের কৃতিত্ব মমতা সরকারের কাছে স্বীকৃত এবং পুরস্কৃত৷ তা সত্ত্বেও রাজ্যবাসী, বিশেষত এই রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষ, যাঁরা জঙ্গি অথবা চোরাকারবারি নন, যাঁরা পরিশ্রমের উপার্জনে বাঁচেন, সৎ, নিয়মনিষ্ঠ, আইনানুগ জীবন কাটান, তাঁরা কিন্তু গভীর উদ্বেগ এবং আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকবেন এই মামলার দিকে৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে নীচে মন্তব্যের ঘরে লিখুন৷