দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য চাই জাতীয় ঐকমত্য
১৬ ডিসেম্বর ২০১০ঐকমত্যের অভাবে উন্নয়ন ব্যাহত
এই বিষয়ে কথা বলেছি আমরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন বীর বিক্রমের সঙ্গে৷ তাদের কাছে প্রশ্ন - স্বাধীনতার চার দশকে বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে৷ জবাবে মেজর হাফিজ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্জন অনেক৷ বিশেষ করে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের কথা বলতে হয়৷ তারা অনেক কষ্ট করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কল কারখানা গড়ে তুলেছেন৷ তাদের কারণে দেশের আয় বেড়েছে৷ সরকারগুলো কিছু কিছু ভালো কাজ করেছে, ফলে ১৯৭২ সালের তুলনায় দেশ অনেকটা এগিয়েছে৷ অর্জনের মধ্যে রয়েছে শিক্ষার হার বিশেষ করে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে৷ শিশু মৃত্যুর হার কমেছে৷ এই অবস্থাতেও প্রবৃদ্ধির হার পাঁচ থেকে ছয় শতাংশে রয়েছে৷ তবে রাজনীতিবিদরা যদি আরও সহনশীল হতেন এবং জাতীয় প্রশ্নে ঐকমত্য রাখতেন তাহলে আমাদের দেশ আরও অনেক এগিয়ে যেতো৷'
তাঁর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে মাহবুব উল আলম হানিফও দাবি করলেন বাংলাদেশের অর্জন অনেক৷ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মত একটি ছোট্ট দেশ, যার সম্পদ সীমিত কিন্তু জনসংখ্যা বিশাল আকারের৷ এসব নিয়েও আমরা অর্থনীতিতে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি৷ বিশ্বের চীন ভারত সহ পাঁচ ছয়টা দেশ বাদ দিলে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে হিসেব করলে আমরা তাদের পরেই৷শিক্ষা খাতেও আমরা এগিয়েছি৷ সব বিবেচনায় আমরা এগিয়ে গিয়েছি৷ তবে আমাদের মধ্যে যদি জাতীয় ঐক্য থাকতো তাহলে আমরা এতদিনে এশিয়ার মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতাম৷ কেবল জাতীয় ঐক্যের অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি, এটাই আমাদের ব্যর্থতা৷'
ঐকমত্য নেই কেন?
দুই রাজনৈতিক নেতাই দেশের অগ্রগতির জন্য জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছেন৷ কিন্তু এই জাতীয় ঐকমত্য নেই কেন? মাহবুব উল হানিফের বক্তব্য, ‘যারা একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা হয়েছিল৷ তিন নেতার জেলহত্যা, আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা সহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে৷ এতসব হত্যাকান্ডের পর স্বাভাবিকভাবেই জাতির মধ্যে একটি বিভক্তি এসে গেছে৷ এসব হত্যাকান্ডের বিচার যতদিন না হবে, ততদিন পর্যন্ত আমার মনে হয় ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন হবে৷'
মেজর হাফিজ বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই৷ তাই নেই জাতীয় ঐকমত্যও৷ যে চেতনা ধারণ করে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে চেতনা ধারণ করে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আহত হয়েছি সেই চেতনা হারিয়ে গিয়েছে৷ এর জন্য দায়ী রাজনীতিবিদরা৷ সরকারের পর সরকার এসেছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য তাদের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য নয়৷ ক্ষমতায় যাওয়ার পর সবাই গণতন্ত্রের বদলে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করায় দেশে সত্যিকার অর্থে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ যতটুকু গণতন্ত্র রয়েছে তা নামে মাত্র৷'
চলছে পারস্পরিক দোষারোপ
জাতীয় ঐকমত্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে পরস্পরকে দোষারোপের রাজনীতি৷ দুই নেতার কথাতেও তা স্পষ্ট হলো৷ আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ বলেন, ‘যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তারা কোন কারণ ছাড়াই আওয়ামী লীগকে প্রো ইন্ডিয়ান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে৷ কারণ আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং ভারত আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল৷ তারা আওয়ামী লীগের যে কোন নীতিকেই ভারতের পক্ষের নীতি হিসেব চিহ্নিত করে থাকে৷'
অন্যদিকে বিএনপি নেতা হাফিজ বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই চাই৷ তবে এর মাধ্যমে যেন রাজনৈতিক সুবিধা না নেওয়া হয়৷ এর মাধ্যমে যেন বিরোধী রাজনীতিকে দমন করার চেষ্টা না করা হয়৷ স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দরকার ছিল৷ কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলটি তা করতে পারেনি৷ যার জন্য জনমনে অনেক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে৷'
কাদা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ হোক
রাজনৈতিক ইস্যুতে ভিন্নতা থাকলেও দুই দলের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে একমত দেশের প্রধান দুই দলের দুই নেতা৷
এই ব্যাপারে হানিফ বলেন, ‘এটা আমরা কখনোই চাই না৷ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গেলে প্রত্যেককেই সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে৷ কিন্তু ইতিহাসকে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে গেলে সেটাকে কেউ যদি কাদা ছোঁড়াছুড়ি বলে তাহলে আমার মতে সেটা ভুল হবে৷ কারণ জনগণের অধিকার রয়েছে সঠিক তথ্যটি জানার৷'
অন্যদিকে ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশের উদাহরণ দিয়ে হাফিজ বলেন, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে যে কোন জাতীয় সমস্যায় সরকার এবং বিরোধী দল এক টেবিলে বসে সমাধানের চেষ্টা করে৷ কিন্তু আমাদের দেশে যে দলই ক্ষমতায় যায়, তারা বিরোধী দলকে উৎখাতের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে৷ ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি অহি-নকুল সম্পর্ক বিরাজ করে৷ এরজন্য আসলের দায়ী রাজনীতিবিদদের পরশ্রীকাতরতা এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা৷'
প্রতিবেদন: রিয়াজুল ইসলাম
সম্পাদনা: আবদুল্লাহ আল-ফারূক