দেশের সবচেয়ে অসহায় ‘প্রজাতি' ভোক্তা
২৯ জুলাই ২০২২অবস্থান ধর্মঘট করতেন তিনি খোদ কমলাপুর রেল স্টেশনের ভিতরে। একাই শুরু করেছিলেন, পরে দেখা গেল তার সঙ্গে আরো কয়েকজন জুটে গেছে। বেশ কয়েকদিন চললো এরকম।
রেল বিভাগ প্রথম দিকে বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি, তাদেরকে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে দিয়েছে। হয়ত ভেবেছিল- ছাত্র মানুষ, উত্তেজনার বশে শুরু করেছে, চলবে কদিন, তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি সেভাবে অগ্রসর হয়নি। রনি হাল ছাড়েনি। বরং দিন দিন তার সঙ্গে লোকজন জড়ো হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এরপর শক্ত হয়েছে, রনিকে স্টেশনের মধ্যে ঢুকতেই দেয়নি। রনি বসে গেছে, স্টেশনের সামনেই। এরপর উটকো লোকজন এসে নানা উল্টাপাল্টা কথা বলে রনিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এতে রনির প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আরো বেড়েছে।
রনির দাবি ছিল খুবই সুনির্দিষ্ট। তিনি নিজে অনলাইনে রেলের টিকেট কিনতে যেয়ে ঠকেছেন। কাজেই অনলাইন টিকেট বিক্রিকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার দাবি করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে বলেছেন, ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি, রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ, ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কসহ অন্যান্য দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ড সার্বক্ষণিক মনিটর, ট্রেনে ন্যায্য দামে খাবার বিক্রি, বিনামূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা। এই দাবিগুলোর কোনোটিই কিন্তু অযৌক্তিক নয়। আসলে এগুলো দাবির বিষয়ই হওয়ার কথা নয়। রেলওয়ে একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। জনগণকে এই সেবাগুলো তাদের এমনিতেই দেওয়ার কথা। অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে এই সেবাগুলো দেওয়ার লক্ষ নিয়েই তারা কাজ করে। অথচ সমস্যা হচ্ছে- যে সেবাগুলো সাধারণ মানুষের পাওয়ার কথা স্বাভাবিক নিয়মেই, সেগুলো পাওয়ার জন্য এখন আন্দোলন করতে হয়, দাবি জানাতে হয়।
এই অবস্থা কেবল রেল বিভাগেই নয়, দেশের অধিকাংশ জায়গাতেই দেখা যায় অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতারণা আর ব্যবসায় যেন সমার্থক হয়ে গেছে। বাজার থেকে মাংস কিনবেন, আর ওজনে কম পাবেন না- তা-ও কি হয়? মাছ কিনতে যাবেন, ভালো মাছ দেখিয়ে ঠিকই কৌশলে গোটা কয়েক পচা মাছ ঢুকিয়ে দেবে আপনার ব্যাগে। একই অভিজ্ঞতা অনেকেই লাভ করেছেন সবজি বা ফল কিনতে যেয়ে। এ তো গেল এক ধরনের প্রতারণা। আর দাম নিয়ে যে অরাজকতা চলে, সেটা তো রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য।
বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে- এমন খবর পাওয়া মাত্র দাম বেড়ে যায় স্থানীয় বাজারে। নতুন দামে তেল আমদানী শুরুই হয়নি, তাহলে আগের কমদামে কেনা তেলের দাম বাড়বে কেন? এমন প্রশ্নের দিতে কেউই রাজি নয়। ভোক্তারা অসহায়, এমনকি পাশে পায় না তারা সরকারকেও। সরকার, তার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলো, সবাই যেন ব্যবসায়ীদের পক্ষে। সরকারের অসাহায়ত্ব মাঝে মাঝে এমন দেখা যায় যে, খোদ মন্ত্রীই বলেন- ব্যবসায়ীরা তার কথা শোনে না! আবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাস হয় যে বৈঠকে, সেখানে মন্ত্রী হাসিমুখে বসে থাকেন ব্যবসায়ীদের পাশে। মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি যখন দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে, ইতিবাচক মাথা নাড়েন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়। এভাবে কিছুদিন যায়। তারপর এক সময় বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমে আসে, সে অনুযায়ী দেশের বাজারেও তেলের দাম কমানোর ঘোষণা হয়, কিন্তু বাস্তবে আর কমে না। কেন কমে না- ভোক্তাদের এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিক্রেতারা অবশ্য বলে- এগুলো আগের দামে, অর্থাৎ বেশি দামে কেনা, নতুন তেল এলে তখন দাম কমানো হবে!
একটা প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে। যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়, মানলাম সেগুলোর দামের ওপর আমাদের তেমন একটা নিয়ন্ত্রণ নেই। বিদেশে দাম বাড়লে আমাদের এখানেও বাড়বে। কিন্তু যে পণ্য আমাদের এখানেই উৎপন্ন হয়, উৎপাদক যখন তা মাঠপর্যায়ে অতি অল্প মূল্যে বিক্রি করে, রাজধানীতে এসে তার দাম আকাশচুম্বী কেন হবে? ঠিক এখানেই এসে যাচ্ছে রাজনীতির কথা, সুশাসনের কথা। এ প্রসঙ্গে কদিন আগে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান একটা বিস্ময়কর তথ্য দিলেন। তিনি জানালেন, টেকনাফ থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকায় আসতে ভাড়া গুণতে হয় ৪০ হাজার টাকা! এত কেন? কারণ, আর কিছু নয়, রাস্তায় ঘাটে ঘাটে তাদেরকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদাতেই চলে যায় কয়েক হাজার টাকা। অনেকে বলেন, চাঁদার বিষয়টা আছে, তবে তারপরও ৪০ হাজার টাকা অনেক বেশি। কিন্তু কিছু করার নেই। কারণ ট্রাক মালিকরা একজোট হয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর কম হলে তারা মাল নেবে না। এদিকে কাঁচামাল বলে কথা, ঢাকায় দ্রুত না আনতে পারলে সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। অগত্যা কিছু করার থাকে না, ওই ভাড়াতেই আনতে হয়। ঢাকায় আনার পর এই বাড়তি অর্থ আদায় করা হয় ভোক্তার কাছ থেকে। ফলে যে সবজি কৃষক বিক্রি করে ১০ টাকায়, ঢাকায় এসে সেটা হয়ে যায় ৩০ টাকা। ব্যবসায়ী মুনাফা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মুনাফার কারণেই দাম এতটা বাড়ে, তা নয়, দামের এই উল্লম্ফনের মূল কারণ চাঁদাবাজ ও পরিবহণ মালিকদের দৌরাত্ম্য। এই মধ্যসত্ত্বভোগীরা কিন্তু কোনোভাবেই উৎপাদন বা বিপণনের সঙ্গে জড়িত নয়। এরা আসলে কালো অর্থনীতির সদস্য। যে কাজটা এরা করে, সরল বাংলায় সেটা নিছক ‘ডাকাতি'। সেটা তারা করে, কারণ, তাদেরকে কেউ বাধা দেয় না। দেশে পুলিশ আছে, তারা হাইওয়েতে টহলও দেয়। কিন্তু ডাকাত ধরতে আগ্রহী নয়, বরং উৎসাহী ‘ডাকাত'-এর কাছ থেকে বখরা নিতে।
পরিবহণের কথা যখন উঠলো, তখন এই সেক্টরের কথা আর একটু বলা যাক। দেশে সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছে বোধকরি এই সেক্টরে। এটি একটি অদ্ভুত খাত। অপকর্ম আর নৈরাজ্যের স্বার্থে এখানে মালিক শ্রমিক- সবাই এক। মালিক সমিতির নেতারা সরকারের লোক, কখনো মন্ত্রী, কখনো এমপি। শ্রমিক সমিতির নেতারা তো আরও ক্ষমতাবান। এরকম এক নেতা আছেন, যিনি দীর্ঘদিন মন্ত্রী ছিলেন, এখনো এমপি আছেন। সরকারি এই লোকদের কারণে, জনস্বার্থে প্রণীত সরকারের আইন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা যায় না।
এই লেখা যখন লিখছি (২৯ জুলাই, ২০২২), এর ঠিক চারবছর আগে, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ২ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে। সে এক অভূতপূর্ব অহিংস আন্দোলন। সড়কে যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ছোট ছোট সেই শিক্ষার্থীরা দারুণ সব পদক্ষেপ নেয়। তারা যানবাহনের ফিটনেস, চালকের লাইসেন্স, ইত্যাদি পরীক্ষা শুরু করে। দেখা যায়, অনেক ভিআইপি'রই গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই, চালকের নেই লাইসেন্স। কয়েকদিনের মধ্যে সড়কে যেন এক অভাবিত শৃঙ্খলা ফিরে আসে। দ্রুতই প্রমাণ হতে থাকে, বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে আমরা যে ট্রাফিক পুলিশদের পালছি, তারা আসলে কাজের চেয়ে অকাজই করেছে বেশি। যে কাজ তারা করতে পারেনি, ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা তা করে দেখিয়ে দিলো!
আলোড়ন জাগানো এই আন্দোলনের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল? সরকার শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহবান জানায়। তারপর দ্রুতই বল প্রয়োগ করে। অনেক জায়গায় তাদের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হয় হেলমেট বাহিনীকে। অনেক শিক্ষার্থীকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তোলা হয় তাদেরকে আদালতে। কী এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি!
আন্দোলন তো থামিয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু সরকার কি পরে ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল? রক্ষার চেষ্টাও করেছিল? এভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে সরকার আসলে কী ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল?
অথচ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন তো আসলে ছিল ভোক্তা অধিকারেরই আন্দোলন। সড়কের জন্য আমি অর্থ দিচ্ছি, পরিবহণে যাতায়াতের অর্থ দিচ্ছি, কিন্তু বিনিময়ে পাচ্ছি না ন্যূনতম সেবা। ভোক্তার এই অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? থাকার কথা তাদের ভোক্তার পক্ষে। কিন্তু বাস্তবে সেটা আর সম্ভব হয় না। হবে কী করে, সড়ক ও পরিবহণে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদেরকে তো নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে মন্ত্রীর চেয়ারে। তারাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সরকার, প্রশাসন আর অরাজকতাকারী- সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ হয়েছে পড়েছে সংখ্যগরিষ্ঠ ভোক্তা শ্রেণি।
দেশে প্রতারণার নতুন আর এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে ই-কমার্সের নামে। প্রযুক্তির এই ব্যবহার পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। সেসব জায়গায় এটি ভালো করছে, ভোক্তার কেনাকাটা সহজ হয়ে যাচ্ছে। আর বিপরীত দিকে, আমাদের এখানে ভোক্তাদের মনে ক্রমেই যেন ই-কমার্স আবির্ভূত হচ্ছে একটা আতঙ্ক হিসাবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা ধরা পড়েছে। উদ্যোক্তাদের অনেকে পালিয়েছে, দু-একজন ধরা পড়েছে। যারা ধরা পড়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা জেলে আছে। কিন্তু এতে ভোক্তাদের লাভটা কী হয়েছে? কিছুই হয়নি। বেশির ভাগই তাদের অর্থ ফেরত পায়নি। প্রতারকরা ধরা পড়ার পর শুরুর দিকে ভোক্তাদের অনেকে হয়তো অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা করেছেন, অপেক্ষা করতে করতে এখন সেই আশাও ধূসর হয়ে যাচ্ছে। এইসব প্রতারণা এই দেশে এতটাই নিরাপদ ও লাভজনক যে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত এতে জড়িয়ে পড়ছে।
এসব তো গেল বড় বড় খাত, ই-কমার্সের নামে ছোট ছোট অর্থের লেনদেন যেখানে হয়, সেখানেও কি ভোক্তারা পাচ্ছেন যথাযথ সেবা? আপনি হয়ত খাবারের অর্ডার করলেন কোনো একটা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। মূল্যটা আগাম দিয়ে দিলেন অনলাইনের মাধ্যমে। তারপর অপেক্ষা করছেন তো করছেন, খাবার আর আসে না। কমপ্লেইনে ফোন করে জানতে পারলেন অদ্ভুত এক তথ্য। ডেলিভারিম্যান নাকি আপনার বাসার নীচে এসে আপনাকে ফোন করেছিল, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে খাবার নিয়ে ফিরে গেছে। ফোন করেছিল, কিন্তু আপনি তো কোনো কল পাননি, মিসড কলও নেই। তাহলে? ওদের মুখস্ত উত্তর, তাহলে হয়ত নেটওয়ার্কে ঝামেলা ছিল। এতসব আলাপচারিতার পর বটম লাইন হলো- যে টাকা আপনি আগেই অনলাইনে পে করেছেন সেটা আর ফেরত পাবেন না! এই যে ঘটনাটি বললাম, এটা কিন্তু বানানো গল্প নয়, আমার নিজের জীবনেই ঘটেছে। এ নিয়ে সপ্তাহ খানেক আগে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছি। আটদিন পার হয়ে গেছে, এখনো কোনো প্রতিকার পাইনি।
তবে আশা হারাইনি। কারণ, বিভিন্ন জনের মুখে শুনেছি, এই জায়গায় অভিযোগ করলে নাকি একটা সুরাহা হয়। হয় যে, এটা তাদের কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে ভোক্তা আইন হওয়ার পর ২০১৩-১৪ অর্থবছর অধিদপ্তরে ১৭৯টি অভিযোগ জমা হয়। এরপর থেকে ভোক্তাদের অভিযোগ বাড়তেই থাকে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে অভিযোগ বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৯১০টি। এছাড়া ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়ে আরও ৮২৪০টি। এ থেকে এতটুকু বোঝা যায়, সরকারি হলেও এই প্রতিষ্ঠানটির উপর মানুষের আস্থা এখনো অনেকটাই আছে।
ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অধিদপ্তর তো রয়েছেই, এর বাইরে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসইটিআই), নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। এদের সকলেরই কাজ- মানুষ যাতে তার পরিশোধিত অর্থের বিনিময়ে যে পণ্য বা সেবা পাওয়ার দাবিদার, তা যেন যথাযথভাবে পায়। কিন্তু এসব আসলে তত্ত্বের কথা। বাস্তবে সরকারের এই সংস্থাগুলো কতটুকু ভোক্তার জন্য নিবেদিত- তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। আর এসবের পাশাপাশি আছে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এটি কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বেসরকারি একটি সংগঠন। অনেক পুরানো এই সংগঠনটির তেমন জোরালো কোনো ভূমিকা দেখা যায় না ভোক্তাদের পক্ষে। এরা মাঝে মাঝে বাজার পর্যালোচনা করে পত্রপত্রিকায় প্রেস রিলিজ পাঠিয়েই নিজেদের দায় সারে।
সবমিলিয়ে এটা বলাই যায় যে, এদেশে সবচেয়ে অসহায় ‘প্রজাতি' হচ্ছে ভোক্তাশ্রেণি। এদের কোনো সংগঠন নেই, এদের কোনো সহমর্মী নেই। সহযোগিতার নামে সরকার বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা অবশ্য করেছে, কিন্তু সেগুলো ভোক্তাদের উপকারের চেয়ে বিভ্রান্তই করে বেশি। ভোক্তাদের সংগঠিত করতে পারতো যে ক্যাব, সেটাও পরিণত হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ভোক্তাদের এই অসহায়ত্বের বিপরীতে সেবাদানের নামে যারা আছে- তারা শক্তিশালী, দুর্বিনীত। ব্যবসায়ীরা সংগঠিত ও প্রতারণা মনোভাবাপন্ন। সময়-সুযোগ পেলেই তারা রীতিমতো সিন্ডিকেট করে নেমে পড়ে প্রতারণার অভিযানে। ভোক্তাদের তখন অসহায়ভাবে মার খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
আর এত প্রতিকূলতার মধ্যে, বিচ্ছিন্নভাবে যখন দু-একটা ঘটনা সামনে চলে আসে, ছাত্ররা সড়কে শৃঙ্খলা ফিরাতে যায়, রেলওয়েতে অনিয়ম বন্ধে রনি হাতে শিকল জড়িয়ে অবস্থান ধর্মঘট করে, সেগুলোকেও দমিয়ে দেওয়া বিচিত্র উপায়ে। রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই তখন নানা পদ্ধতি গ্রহণ করে বিষয়টি থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে। কোমলমতি ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি কদিন আগে রনিকেও দেখলাম রেলের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে চার ঘন্টা ধরে বৈঠক শেষ করে আন্দোলন স্থগিত করতে। এই যে আন্দোলন স্থগিত করা, এটা কেন? ছয় দফা দাবির সব কটি, অথবা কোনো একটিও কি বাস্তবায়িত হয়েছে? হয়নি যে- সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য আন্দোলন স্থগিতের কারণ হিসাবে রনি দুটি কথা বলেছেন। বলেছেন, রেল বিভাগ নাকি আশ্বাস দিয়েছেন, সব অনিয়ম দূর করা হবে! আর দ্বিতীয় কথাটি আরো কৌতুকপ্রদ। তার এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ যাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, সেজন্য আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে।
ভোক্তাদের পক্ষে আমাদের আন্দোলনগুলো এভাবেই ইন্তেকাল করে। বিনিময়ে রনির মতো ‘আপসহীন'রা রেলের ‘অংশীজন কমিটি'তে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার সুযোগ পান।