দুর্লভ ছবিতে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস
বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ ও ৬৪ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ছাত্রসমাজের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা
এদেশের ভূখণ্ডের জন্মের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা৷ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করায় তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অপরিসীম৷
তৎকালীন ছাত্রনেতারা
নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন থেকে শুরু করে তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন এবং ওই সময়ের অন্যসব জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ছাত্রনেতারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি করতেন৷
ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে পরবর্তীতে তারা প্রত্যেকেই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একেকটি পিলার হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন৷ ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন৷
বঙ্গবন্ধু পথপ্রদর্শক
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী যে কোনো রাজনীতিবিদ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য পথপ্রদর্শক৷ বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকে রাজনীতি ও অধিকার সচেতন ছিলেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি৷
ছয়দফা কর্মসূচি
১৯৬৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হলে ছয়দফা সমর্থন ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে৷
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালে সকল ছাত্রসংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১-দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে৷ এর ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবকে মুক্তিদানে বাধ্য হয়৷ মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রদের এ প্রভাবকে স্বীকৃতি দেন৷
স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের ১ মার্চের পরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়৷ ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে৷ পরদিন তারা পল্টন ময়দানে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়৷ শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ৷
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে৷ ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্তুত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি৷ উল্লেখ্য, মুজিবনগর সরকার যথার্থভাবেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জাতীয়তাবাদী অভিধাগুলি, যেমন দেশের নাম, জয় বাংলা স্লোগান, জাতীয় পতাকা ইত্যাদিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল৷
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অহঙ্কার করার মতো৷ গোটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়৷
স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং ১৯৯১ সালে তাঁর পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে পুনরায় ছাত্ররা ঐক্য ও শক্তির পরিচয় দিয়েছে৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতন হয়৷ শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রযাত্রা৷
২০০২ শামসুন্নাহার হল আন্দোলন
২০০২ সালের ২২ জুলাই রাত ১টায় অর্থাৎ ২৩শে জুলাই দিবাগত রাতে শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর রাতের অন্ধকারে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলনে উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ ২৩ শে জুলাই সকাল থেকে ছাত্রদল ব্যতীত ক্যাম্পাসের ক্রীয়াশীল সব ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে৷ ১ লা আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন ভিসি৷
২০০৭ সালে ছাত্র আন্দোলন
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় চার শিক্ষক ও আট শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আটক হন আট শিক্ষক, এক কর্মকর্তা৷
ছাত্র আন্দোলনের মুখে শিক্ষকদের মুক্তি
দু’দিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত কয়েকশ জন আহত হয়৷ পরে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে দণ্ড পাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে ডিসেম্বরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার৷ ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে আটক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের ছেড়ে দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷