‘‘দুয়ারে সরকার'' কি মমতার মাস্টারস্ট্রোক
১২ ডিসেম্বর ২০২০পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন এখনো পাঁচ-ছ'মাস দূরে। তার আগেই ভোটারদের মন পেতে নানা পন্থা নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি। ক্ষমতাসীন দল সরকারি পরিষেবাকে আরো উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনতাকে ছুঁতে চাইছে। এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগ ‘‘দুয়ারে সরকার'' কর্মসূচি। এই কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যসাথী, খাদ্যসাথী, কৃষক বন্ধু, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, শিক্ষাশ্রী-সহ রাজ্য সরকারের একগুচ্ছ প্রকল্পের সুবিধা সরাসরি নাগরিকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মানুষ দলে দলে ভিড় করছে শিবিরগুলিতে।
এই প্রকল্পগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছে স্বাস্থ্যসাথী। শিবিরে নাম নথিভুক্ত করালে কার্ড দেওয়া হচ্ছে আবেদনকারীকে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, এই কার্ড হাসপাতালে দেখিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ পেতে পারেন যে কেউ। তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেছেন, ‘‘মানুষের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যসাথী ঘিরে। বিপুল সংখ্যায় মানুষ কার্ড করাতে আসছেন।'' এই প্রকল্প স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে দাবি তৃণমূল নেতৃত্বের।
নির্বাচনের আগে ‘‘দুয়ারে সরকার'' কর্মসূচিকে মুখ্যমন্ত্রী ‘‘মাস্টারস্ট্রোক'' হিসেবে দেখছে শাসকদল। আইন-শৃঙ্খলা থেকে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা এই জনসংযোগের ফলে অনেকটাই প্রশমিত হবে বলে মনে করছে তারা। বিরোধীরা কটাক্ষ করেছে এই কর্মসূচিকে। বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘শিবিরে এত মানুষের ভিড় দেখে বোঝা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে কোনো পরিষেবা দেওয়া হয়নি। সকলে যদি সরকারি দপ্তরে গিয়ে ঠিকঠাক পরিষেবা পেতেন, তাহলে শিবিরে এত ভিড় দেখা যেত না।''
সরকারকে কাজে লাগিয়ে জনসংযোগের এই কর্মসূচি প্রাথমিকভাবে সাড়া জাগিয়েছে বলেই মনে করেন রাজনীতির বিশ্লেষক অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ। তিনি বলেন, ‘‘শিবিরে প্রচুর মানুষের ভিড় হচ্ছে দেখে বোঝা যাচ্ছে এই উদ্যোগ মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু এটা অভিনব কিছু নয়। এর আগেও অন্য রাজ্যে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'' বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ‘‘আপনার দরজায় আপনার সরকার'' বলে একটি কর্মসূচি নিয়েছিলেন। ওই রাজ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। নীতীশ যে কর্মসূচির ফলে ভোটে সাফল্য পেয়েছেন, তা মমতাও কি পাবেন? অধ্যাপকের মন্তব্য, ‘‘এতে তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মানুষ সবাই ফিরে আসবে, এমনটা মনে হয় না। শিবিরে ভিড় মানেই সেটা ভোটে পরিবর্তিত হবে, এটা সরল সমীকরণ হয়ে যাবে। আসলে রাজ্য রাজনীতিতে আরো অনেক বড় ইস্যু রয়েছে, সেগুলি বিবেচনা করে মানুষ ভোট দেবে।''
এই কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প। সাধারণ মানুষ কার্ড পেয়ে খুশি। কিন্তু, এটা কতটা কাজে আসবে চিকিৎসায়? সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম-এর কর্তা, চিকিৎসক স্বপন বিশ্বাস বলেন, ‘মূল ভাবনায় গলদ রয়েছে। কার্ড ব্যবস্থায় লাভ বেশি হয় বিমা কোম্পানির। এই টাকা স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতিতে খরচ করলে মানুষের বেশি উপকার হত।'' কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে পাঁচ লক্ষ টাকার বিমা দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসাথীর ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক এক লক্ষ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লক্ষ করা হয়েছে। চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা হয়। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল এই কার্ডকে মান্যতা দেবে না। গরিব মানুষ হতাশ হবে।''
জনসংযোগের এই কর্মসূচি ঘিরে কোথাও কোথাও শাসকদলের কোন্দলও সামনে এসেছে। অনেক জায়গায় ভিড় বেশি হওয়ায় শিবির পরিচালনায় শৃঙ্খলার অভাব দেখা যাচ্ছে। তাই নবান্ন শিবির বাড়ানোর পথে এগিয়েছে। শিবিরে এসে যদি সকলে আবেদন নাও করতে পারেন, তা হলে সরকারি কর্মীদের পাঠানো হবে বাড়ি বাড়ি। সেখানেই ফর্ম পূরণ করে নেওয়া হবে। এই উদ্যোগ সত্যিই কি মমতার ‘‘মাস্টারস্ট্রোক''? এতে কি কমিয়ে আনা যাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা? আগামী নির্বাচনে প্রশ্নের জবাব দেবেন বাংলার ভোটাররা।