‘ধর্মের প্রভাব বাড়বে, কমবে না’
৩ অক্টোবর ২০১৬বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ দলটির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই হয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, না হয় কারাগারে রয়েছেন৷ দলটির নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে, অনেকেই পলাতক জীবনযাপন করছেন৷ গত জাতীয় নির্বাচনের আগেই দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু এখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি৷ অনেকেই মনে করছেন দলটির আর কোনো ভবিষ্যত নেই, ভবিষ্যতে জামায়াতের মাথা-চাড়া দিয়ে উঠার কোনো সম্ভাবনাও নেই৷ কিন্তু আমার ধারণা, সামনের দিনে ইসলামি দল, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর জনগ্রহণযোগ্যতা বাড়বে৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া নেতাদের আদর্শ মেনে চলা এই দলটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে৷ সেটা জামায়াতে ইসলামী নামে না হয়ে অন্য নামেও হতে পারে৷
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গীভূত হবার সুযোগ আসে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে৷ যদিও এর আগেই তারা বাংলাদেশের রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো মূলধারার প্রধান দু'টি দলের সাথে কাজ করার সুবাদে জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়৷ নব্বই-এর দশকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ – দুই পক্ষই ক্ষমতায় যাবার জন্য জামায়াতের ভোট ব্যাংককে কাজে লাগিয়েছে৷ এ জন্য অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতকে একটি ‘কিংমেকার' (বাংলাদেশের প্রক্ষাপটে পড়ুন কুইনমেকার) দল হিসেবে দেখেন৷ রাজনীতির মারপ্যাঁচে এখন জামায়াত আওয়ামী লীগের বড় শত্রু আর বিএনপির বড় মিত্রতে পরিণত হলেও, দুই দলই জামায়াতকে নিজেদের হালুয়া-রুটির ভাগ দিয়েছে৷ জামায়াতে ইসলামী একটি ক্যাডারভিত্তিক সুসংগঠিত দল৷ বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কীভাবে জামায়াত তাদের সংগঠন পরিচালনা করেছে, দলের আয়ের জন্য নিশ্চিত ব্যবস্থা করেছে৷
জামায়াতের সদস্য ও কর্মীরা তাদের মাসিক আয়ের শতকরা ৫ ভাগ দলের জন্য দান করেন৷ আরেকটি সূত্র অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তাদের কর্মীদের পাঠানো হয় এবং পরবর্তীতে তারা পার্টি ফান্ডে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমান অর্থ প্রদান করেন৷ কোচিং সেন্টার, ক্লিনিক, পরিবহন, ব্যাংক, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে৷ এ সব সংগঠন যেমন দলের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে দেয়, তেমনি দলের সদস্যদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে৷ অধ্যাপক আবুল বারাকাতের একটি গবেষণা অনুযায়ী, জামায়াত সংশ্লিষ্ট এ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বাৎসরিক লাভের মোট পরিমাণ ২০ কোটি মার্কিন ডলার৷ অবশ্য এ গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে প্রায় দশ বছর আগে৷ বর্তমানের পরিবর্তীত বাস্তবতায় এ আয়ের পরিমাণ কমতে অথবা বাড়তে পারে৷
জামায়াতকে কীভাবে জনবিচ্ছিন্ন করা সম্ভব
কোচিং সেন্টার, ব্যাংক, বিমা, মিডিয়া ইত্যাদি প্রভাবশালী ও লাভজনক খাতে তাদের বিনিয়োগ দলটিকে শক্তিশালী করেছে৷ তাই রাজনৈতিকভাবে এ দলটিকে কোনঠাসা করা গেলেও এর অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি জোরালো ও তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত৷ গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত শক্ত অবস্থান রয়েছে এ দলটির৷ এ দলটিকে জনমানস থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য নির্যাতন-জেল-জুলুম নয়, বরং মানসিক ও আদর্শিক লড়াইয়ের জায়গা তৈরি করতে হবে৷ নানা দেশেই দেখা গিয়েছে, নির্যাতন বা হয়রানি শেষপর্যন্ত একটি দলকে জনপ্রিয় করে তুলতে পারে৷ শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের সঠিক বিচার যেমন ঐতিহাসিকভাবে জরুরি, তেমনি দলটির কর্মীদের নির্বিচার হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধ হওয়াও উচিত৷ কারণ এ ধরনের হয়রানি শেষপর্যন্ত তৃণমূলে তাদের জন্য সহানুভূতি তৈরি করতে পারে৷ যা শেষ পর্যন্ত দলটির জন্য লাভজনক হবে৷
জঙ্গিবাদের প্রতি সমর্থন
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি একটি অদ্ভুত সময় পার করছে৷ ২০১৪ এর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর যে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, তা কোনো ধরণের গণতন্ত্র তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের জন্য একটি চমৎকার গবেষণার বিষয় হতে পারে৷ বিরোধী দল হিসেবে যে জাতীয় পার্টি সংসদে বসেন, তারা আওয়ামী লীগের অনেক নেতার চেয়েও বড় সরকার সমর্থক বলে তাদের কথা শুনে মনে হয়৷ সত্যিকারের বিরোধী দল বিহীন এই গণতন্ত্রে যাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেই বিএনপি কোনোভাবেই সরকারের নির্বিচার মামলা, গ্রেপ্তার, ও কারাদণ্ডের বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারছে না৷ দলটির নেতাদের জোরালো, কঠিন আন্দোলনের ডাক অনেকের কাছেই হাস্যরস ও তামাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তার মানে বর্তমান বাংলাদেশে একটি প্রবল প্রতাপশালী, প্রায় একনায়কতান্ত্রিক একটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দেশের প্রায় সবক্ষেত্র নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছে, এবং এই প্রতাপের বিরোধিতা করার মতো কোনো শক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না৷
এমন পরিস্থিতিতে জনগণ তার অসন্তোষ, ক্ষোভ, ও ক্রোধ প্রকাশের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম খুঁজবে৷ জনগণের সামনে একটি বিকল্প হচ্ছে জঙ্গিবাদ৷ জঙ্গি সংগঠনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাংলাদেশে বাড়ছে, সাম্প্রতিক একটি জরিপেও সেই কথাই বলছে৷ ক্রিস্টিনা ফেয়ার এবং অন্যান্যরা পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৪ সালে পরিচালিত জরিপের ওপর ভিত্তি করে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে উগ্রবাদের প্রতি সমর্থন আশংকাজনকভাবে বাড়ছে৷ এমনকি পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বেশি হারে বাংলাদেশে জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলার পক্ষে জনসমর্থন পাওয়া গেছে৷ শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার পক্ষেও অনেক জনসমর্থন রয়েছে৷ মডারেট মুসলমান দেশ হিসেবে পরিচিত একটি দেশের এই পরিবর্তনের পেছনে কারণ কী?
আমার মতে, বাংলাদেশের মাটি জঙ্গিবাদের চাষ করার জন্য উপযুক্ত নয়৷ তাই জনগণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর চাইতে ভবিষ্যতে ইসলামি দলগুলোর দিকে বেশি নির্ভর করবে৷ যে কোনো অস্থিতিশীল ও অসহয়নীয় সময়ে ধর্মভিত্তিক দল একটি ইউটোপিয়ান, শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখায়, যা জাগতিক যে কোনো সমাধানের চেয়ে জনগণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়৷ ইসলামপন্থিদল হিসেবে জামায়াত সবসময় ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েমের কথা বলে এসেছে৷ তাদের কার্যক্রম, দলীয় নেতাদের বক্তব্য ও প্রকাশনায় তা স্পষ্ট৷ সরাসরি শাসনক্ষমতায় বেশিরভাগ সময় না থেকেও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে সেক্যুলার থেকে ইসলামিক চেহারা দিতে সফল হয়েছে৷ তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে ধর্মভিত্তিক দলকে নিষিদ্ধ করা কঠিন এবং সাম্প্রতিক সময়ের জরিপ অনুযায়ী অনুমান করা যায় যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়বে, কমবে না৷
তাই সামনের দিনে আওয়ামী প্রতাপ, একনায়কসুলভ আচরণ ও বিএনপির বিরোধী দল হিসেবে ব্যর্থতা জনগণের সামনে একটি বিকল্পই খোলা রাখবে৷ আর সেই বিকল্প হচ্ছে জামায়াতে ইসলামকে সমর্থন ও দল হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো৷ এই বিপর্যয়ের সমাধান হতে পারে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক একটি সরকার ও কার্যকরী একটি বিরোধী দল৷ তাই সুষ্ঠু নির্বাচন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি ছাড়া এ ধরনের সংকট আরো ঘণীভূত হবে এবং নতুন সংকটের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷