দুই মাসে ‘মব জাস্টিস’-এর নামে ৪৯ বিচারবহির্ভূত হত্যা
৪ অক্টোবর ২০২৪তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, এ সময়ে সারা দেশে কমপক্ষে ৪৯টি এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কারণ, বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া যে-কোনোভাবে যে-কোনো হত্যাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৪৯ জনের৷ পুলিশ সদর দপ্তরের দাবি, তারা এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে৷ তবে সারা দেশে কমপক্ষে ৪৯ জনকে পিটিয়ে মারা হলেও তিনটি ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীঘিনালার ঘটনার পর মঙ্গলবার আবারো পাহাড়ে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামের ওই শিক্ষকে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়৷ তারপরও সংঘর্ষ এবং বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷
এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ তার জের ধরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি বাঙালি সংঘর্ষে চার জন আদিবাসী নিহত হন৷ অনেক ঘরবাড়িতে হামলা এবং অগ্নি সংযোগ করা হয়৷ আগুনে পুড়ে যায় অনেক বাড়ি-ঘর৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকারের হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে৷ দুই মাসেও তারা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারছেন না৷ এটা মেনে নেয়া যায় না৷’’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘কোনো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির নানা ধরনের দায়িত্বহীন কথাও পরিস্থিতি খারাপ করছে৷’’
বিশ্বিবদ্যালয়সহ নানা স্থানে বিচারবহির্ভূত হত্যা
গত ১৮ সেপ্টেম্বের দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে মারা হয় দুজনকে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে চোর অপবাদে দিয়ে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে৷
এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় পঙ্গু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে৷
এদিকে চট্টগ্রামে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নাচ-গান করে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার এক মাস পর সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই ৯ মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৮১ জনকে গণপিটুনি বা পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ তার মধ্যে আগস্ট মাসে হত্যা করা হয়েছে ২১ জনকে আর সেপ্টেম্বর মাসে ২৮ জনকে৷ অর্থাৎ, এই দুই মাসে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৪৯ জনকে৷ আগের সাত মাসে এমন ঘটনা অনেক কম৷ ওই সাত মাসে ৩১ জনের মৃত্যু হয় গণপিটুনিতে৷
গণপিটুনির বাইরে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হেফাজতেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ গাইবান্ধা ও ময়মনসিংহে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হেফাজতে৷
তবে নবনিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের দাবি - ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যার ঘটনা ঘটেনি৷
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া, সেটা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হোক আর গুপপিটুনিতে হোক, সব হত্যাকাণ্ডই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এই যে মব জাস্টিসের নামে হত্যার ঘটনা ঘটছে, এর দায় তো সরকারকে নিতে হবে৷ এসবও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড৷ জণগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো সরকারের৷’’
তার কথা, ‘‘হত্যা ছাড়াও আরো অনেক ধরনের মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে৷ রাষ্ট্রের যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার, সেটা হয়নি৷ স্থিতিশীলতা আসেনি৷ এখন যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আছেন, তাদের কঠিনভাবে দক্ষতার সঙ্গে যে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল, তারা সেটা নেননি৷ হয়ত তাদের সেই দক্ষতা নাই৷ এরপর পুলিশ বাহিনীকে ডিমরালাইজ করা হয়েছে৷ তাদের মনোবল ভেঙে দেয়া হয়েছে৷ এইসব কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷’’
তার কথা, ‘‘এখন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মব জাস্টিস হচ্ছে৷ এই ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে, যদি এই পরিস্থিতিকে স্ট্রংলি হ্যান্ডেল করা না হয়৷ আইন-শৃঙ্খলাসহ সব ক্ষেত্রেই যে একটি অস্থির পরিস্থিতি চলছে, বিচারাঙ্গনেও অস্থিরতা আছে৷ এগুলো স্বাভাবিক করতে হবে৷’’
অন্যদিকে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোর ব্যাপারে ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো পদক্ষেপ আমরা নিতে দেখিনি৷ ফলে মব জাস্টিস উৎসাহিত হচ্ছে৷ যদি কাঠোর ব্যবস্থা নেয়া হতো, তাহলে এগুলো ঘটতো না৷’’
তার কথা, ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ আগেও একই ঘটনা সেখানে ঘটেছে৷ ফলে ওই এলাকায় এক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ এর পিছনে কোনো গোষ্ঠীর হাত থাকতে পারে৷ কিন্তু সরকারকে তো সেটা বের করতে হবে৷ আসলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি অব্যাহত আছে৷ ফলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে৷’’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, ‘‘সরকার অনেকটা নমনীয় ভূমিকায় আছে৷ ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না৷’’ তিনি বলেন, ‘‘আমরা বলেছিলাম রাজনৈতিক দলসহ সবার সঙ্গে কথা বলে একটা নীতিমালা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে৷ কিন্তু ছাত্রদের পরামর্শে সব করা হচ্ছে৷ ছাত্রসহ আরো কিছু লোকের ওপরে সবকিছু ছেড়ে দেয়া হয়েছে৷ এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে, একটা মবের মধ্য দিয়ে যেন সব কিছু আদায় করা যাবে৷ সেই প্রবণতা তৈরি হয়েছে৷ এটা একটা ভয়াবহ প্রবণতা৷’’
আর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘‘যারা ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করেছেন, তারা যদি মব জাস্টিস করেন সেটা দুঃখজনক৷ আর প্রতিহিংসাপরায়ন না হয়ে আমাদের আইনের শাসনের দিকে যেতে হবে৷ সেটা করতে না পারলে আমরা সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না৷’’
অ্যাটর্নি জেনারেল দেশের বাইরে থাকায় বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ তবে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনির ঘটনায় ছয় জনকে গ্রেপ্তার করেছি৷ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দুইজন এবং চট্টগ্রামে নাচ-গান করে একজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বাকি ঘটনায় আমাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে৷ আর এখন তো অধিকাংশ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়৷ তাই আশা করি বাকিদের গ্রেপ্তার সহজ হবে৷’’
তিনি জানান, ‘‘পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপি মহোদয় পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে মব জাস্টিস বন্ধ করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলেছেন৷ দেশের থানাসহ সব পুলিশ ইউনিটকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ আর এই ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটলে পুলিশকে দ্রুত খবর দিতে জনসাধারণকে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছে৷ পুলিশ সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে রেসপন্স করবে৷’’