দিনের আলো ছাড়া শরীরের ‘ঘড়ি’ ঠিকমতো চলে না
১৪ মার্চ ২০২২আলো মানুষের মনে আনন্দ জাগায়৷ বিশেষ করে স্বাভাবিক সূর্যের আলো আমাদের মন-মেজাজ সত্যি ভালো রাখে৷ কিন্তু বছরের শীতল ও অন্ধকার সময়ে অনেক মানুষ এক সমস্যার মুখে পড়েন৷ তারা সুর্যের আলোর মুখ খুব কম দেখেন৷ তখন আমাদের হরমোন নিঃসরণ প্রক্রিয়া এলোমেলো হয়ে যায়, যার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে৷ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মাজদা আদলি বলেন, ‘‘শীতের মাসগুলি অপেক্ষাকৃত অন্ধকার হয়৷ ফলে বেশি মেলাটোনিন নিঃসৃত হয়৷ মেলাটোনিন আমাদের ক্লান্ত করে তোলে, কারণ সেটি ঘুমের হরমোন৷ ফলে শীতের ঋতুতে অনেক মানুষ বেশি ক্লান্তি বোধ করেন, শরীরে জোর পান না৷ অনেকে তথাকথিত ‘উইন্টার ব্লুজ'-এ ভোগেন৷''
কিন্তু ‘উইন্টার ব্লুজ'-এর অর্থ কী? হাসপাতালে আলোর থেরাপির সময়ে প্রতিদিন আধ ঘণ্টা করে দিনের আলোর মতো দেখতে কৃত্রিম বাতির সামনে বসে থাকতে হয়৷ সেটি সূর্যের আলোর স্পেকট্রাম নকল করে, যা আমাদের ঘুমানো ও জেগে থাকার চক্রের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ প্রফেসর আদলি মনে করেন, ‘‘আলোর থেরাপি ঠিকমতো প্রয়োগ করা জরুরি৷ তার জন্য বিশেষ লাইট থেরাপি যন্ত্র রয়েছে৷ বেশিরভাগ যন্ত্র ১০,০০০ লাক্স আলো বিকিরণ করে৷ এমন বাতির সামনে সাধারণত সকালে আধ ঘণ্টা সময় কাটাতে হয়৷ সে সময়ে কিছু পড়া যায়, সামান্য কাজ করা যায় অথবা প্রাতরাশ করা যায়৷ সব কোণ থেকে রেটিনায় আলো পড়া জরুরি৷''
বাতির প্রকার অনুযায়ী আলোর তেজ ও পদ্ধতি বদলে যায়৷ কিন্তু থেরাপি কখনো ৩০ মিনিটের বেশি হতে পারে না৷ এই সময়ই যথেষ্ট৷ কয়েকটি সেশনের পরেই প্রায় সব রোগীই ইতিবাচক পরিবর্তন টের পান৷
আলো আমাদের শরীরের নিজস্ব বায়োলজিকাল ক্লকের উপর প্রভাব ফেলে৷ ২৪ ঘণ্টার চক্র অনুযায়ী সেটি কাজ করে এবং শরীরের সব জৈবিক প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে৷ সেই ঘড়ি যাতে ঠিকমতো চলে, তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত সমন্বয় করা জরুরি৷
সেই সিনক্রোনাইজেশন প্রক্রিয়ার খাতিরে শরীরের ঘড়ির দিনের আলোর প্রয়োজন হয়৷ ক্রোনোবায়োলজিস্ট হিসেবে প্রফেসর আখিম ক্রামার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘জন্মসূত্রেই আমাদের অন্তরে এক শান্ত ভাব থাকে৷ তবে সেটা মোটেই ২৪ ঘণ্টা দীর্ঘ হয় না৷ প্রতিদিন সূর্যের আলোর মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার জন্য সিনক্রোনাইজ করতে হয়৷ সেটা ছাড়া আমরা ২৪ ঘণ্টার ছন্দে বাঁচতে পারতাম না৷ সে কারণে আমাদের বিশেষ করে সকালের স্বাভাবিক আলোর প্রয়োজন হয়৷''
রেটিনার ব্লু লাইট রিসেপ্টরে আলো ধরা পড়ে৷ সেই সংকেত মিডব্রেনে পৌঁছে শরীরের নিজস্ব ঘড়ি সিনক্রোনাইজ করে৷ প্রফেসর ক্রামার বলেন, ‘‘আসলে শরীরের সব প্রক্রিয়া সেই ‘ইনার ক্লক' দ্বারা পরিচালিত হয়৷ ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার ছন্দ থেকে শুরু করে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, কিডনির ক্রিয়া, মেটাবলিজম বা বিপাক, রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি অনেক কিছুই শরীরে ঘড়ির মাধ্যমে ঘটে৷ আমরা সতর্ক না হলে এবং যথেষ্ট আলোর মাধ্যমে ভালোভাবে সিনক্রোনাইজ না হলে নানা প্রচলিত রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়৷''
লাইট থেরাপি শীতকালেও দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে এবং মনও তরতাজা রাখে৷ কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃত অবসাদের ক্ষেত্রে এই থেরাপি কাজ করে না৷ শীতকালে হালকা অবসাদ দেখা দিলে অবশ্য দুই সপ্তাহের মধ্যেই কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যায়৷
তাছাড়া দিনের বেলা যতবার সম্ভব বাসা থেকে বের হওয়া জরুরি৷ কারণ, তাজা বাতাস নিতে নিতে শরীরের মুভমেন্ট আমাদের মনমেজাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব রাখে৷
টোমাস রুগে/এসবি