দাম্পত্য ধর্ষণ অপরাধ নয়?
২০ মার্চ ২০১৬সাংসদটি হলেন কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী মানেকা গান্ধী৷ অথচ গতবছরেই ঐ মন্ত্রী বলেছিলেন, দাম্পত্য জীবনে ধর্ষণকে অপরাধ বলে গণ্য করা উচিত৷ তাছাড়া খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতিসংঘে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন যে, ভারতীয় সমাজে সব রকম নারী নির্যাতন ও হিংসা রোধ করা হবে৷ দূর করা হবে নারীদের প্রতি বৈষম্য৷ সুনিশ্চিত করা হবে নারীদের নিরাপত্তা৷
এরপর সংসদেও একই কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ তাহলে কেন সরকার রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে এখন বলছে যে, ভারতীয় আইনবিধি সংশোধন সম্ভব নয়? সরকার যুক্তি দিয়েছে, ভারতে মেয়েদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষার অভাব, গরিবি, নানা সামাজিক সংস্কার এবং সর্বোপরি ধর্মীয় বিশ্বাস, যেটা বৈবাহিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে৷ শুধু তাই নয়, বৈবাহিক ধর্ষণকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে আদালতে প্রমাণ করাও সহজ নয়৷ এ সম্পর্কে ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট আইনি সংস্থানও নেই৷ দৈহিক নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে তা প্রমাণ করা গেলেও, স্ত্রীর সম্মতি ছিল কিনা সেটা আদালতে প্রমাণ করা বেশ কঠিন৷
তাই প্রশ্ন হলো, ভারতের নারী সমাজের কাছে এ সব যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য? নারী সমাজের এক অংশের মতে, মহিলা ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী যাই বলুন, স্ত্রীর সম্মতিহীন যে-কোনো যৌন সম্পর্কই আসলে ধর্ষণ৷ স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, শারীরিক সুস্থতা-অসুস্থতার তোয়াক্কা না করে নিজের যৌন চাহিদা মেটানো ধর্ষণ ছাড়া আর কী? নতুন দিল্লিতে জাতিসংঘের নারী সংক্রান্ত এক সম্মেলনে জাতিসংঘের এক কর্তাব্যক্তিও এমনটাই মনে করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘মহিলাদের নিরাপত্তায় সরকারের দায়বদ্ধতা নিয়ে সংশয় নেই, কিন্তু সেটা সুনিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷ গোটা বিশ্বে সেটা জাতিসংঘেরও লক্ষ্য৷ ধর্ষণ ধর্ষণই, যদি না তাতে মহিলার সম্মতি থাকে৷''
মানেকা গান্ধীর মতে, গরিব, অশিক্ষিত স্ত্রীরাই বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হন বেশি৷ তথ্যগতভাবে এটা ঠিক নয়৷ অনেক শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়েরাও এর শিকার৷ আসলে স্ত্রীর ওপর নিজের অধিকার ফলাতে, তাকে নিজের অধীনে রাখতে, পতি দেবতাদের এটা একটা সাধারণ হাতিয়ার৷ তাই বহুচর্চিত বিবাহকে ধর্মীয় পবিত্রতার তকমা দিয়ে ভারতীয় নারীদের ওপর ক্রমাগত চলতে থাকা দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন কখনই মেনে নেয়া যায় না৷ ২০১২ সালে নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের পর বিচারপতি বর্মা কমিটির রিপোর্টে বৈবাহিক ধর্ষণকেও সামগ্রিকভাবে যৌন নিপীড়নের আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুপারিশ করা হয়৷ বলা হয়, বিয়ে করা বৌ মানে স্বামীর সম্পত্তি – এই আদ্যিকালের মানসিকতা থেকেই বৈবাহিক ধর্ষণকে এতদিন মেনে নেয়া হয়েছে৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দক্ষিণ-পূর্ব বিভাগের অধিকর্তা এবং বিশিষ্ট নারী ব্যক্তিত্ব মীনাক্ষি গাঙ্গুলি ডয়চে ভেলেকে বলেন, কেন্দ্রীয় এই মন্ত্রী ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে যদি এটাকে অপরাধযোগ্য মনে না করেন, তাহলে সেটা অনুচিত হবে৷ সাংসারিক হিংসাকে বিয়ের পবিত্রতা ইত্যাদিতে মুড়ে এক সময় আইনি অপরাধ বলে গণ্য করা হতো না৷ যেমন স্বামী খেটেখুটে এসে নুন কম পড়লে বৌকে চড় থাপ্পড় মারতো, সেটাকে দোষ বলে ধরা হতো না৷ এখন সেটা বন্ধ হয়েছে৷ বৈবাহিক ধর্ষণকেও বন্ধ করতে হবে ঠিক সেভাবেই৷ বিবাহিত মানেই সেই নারীর সব রকম দৈহিক ও মানসিক উত্পীড়নে প্রচ্ছন্ন সম্মতি রয়েছে, এমনটা হতে পারে না৷
তাঁর কথায়, ‘‘আমরা আশা করি, মন্ত্রী হিসেবে মানেকা গান্ধী যাই বলে থাকুন, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তিনি তাঁর আগের অবস্থানেই অবিচল থাকবেন৷ ইস্যুটা নিয়ে কোনো রাজনীতি করবেন না৷'' মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলেন, ‘‘বৈবাহিক সম্পর্ক যাই হোক, মহিলাদের নিজ দেহের ওপর স্বাধিকার বজায় রাখতে আইনি সংস্থান থাকা জরুরি৷ অন্যথায় ভারতে নারী স্বাধীনতা থেকে যাবে অধরা৷''
আপনিও কি দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধ বলবেন? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷