ইতিহাস গড়ল অভুক্ত মানুষরা
১৩ মার্চ ২০১৮সূর্যোদয়ের রক্তিম আভার মতো এদিন জেগে ওঠে লাল পতাকা৷ নাসিক থেকে বাণিজ্য নগরী মুম্বই৷ পথটা নেহাত কম নয়৷ ১৮০ কিলোমিটার খালি পায়ে হেঁটে রক্ত ঝরেছে পায়ে, তবু হাঁটা বন্ধ হয়নি৷ অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে অদম্য জেদে ভর করে সুশৃঙ্খলভাবেই এগিয়েছেন তাঁরা৷ আদিবাসী রমনীরা মিছিলে পা-মিলিয়ে বলছেন, ‘আমিই লেনিন, আমিই স্ট্যালিন!'
ওঁরা মুম্বই শহরের ঢুকতেই রাজপথে পুস্পবৃষ্টি করে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন অগণিত মানুষ৷ ছাত্ররা তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন জল, বিস্কুটের প্যাকেট, পোহা৷ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলি প্রথমদিকে খুব একটা গুরুত্বই দেয়নি৷ কিন্তু শেষমেশ গুরুত্ব আদায় করে নিয়েছেন মেহনতি মানুষরাই৷ মাইলের পর মাইল হেঁটে অবশেষে জয়ী ওঁরা৷
‘দাবি আদায় করেই ছাড়ব, সরকারি প্রতিশ্রুতি আর মানব না' – মূলত এই দাবিকে সামনে রেখে নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুধুমাত্র নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সামিল হন কয়েক হাজার কৃষক৷ মুম্বইয়ের রাজপথে তাঁরা ওড়ান প্রতিবাদের লাল ধ্বজা৷ মিছিল মালাডে পৌঁছাতেই হয় পুস্পবৃষ্টি৷ ভিখরোলিতে স্কুল ছাত্র এবং বাসিন্দারা পোস্টার নিয়ে রাস্তার দু'পাশে দাঁড়িয়ে কিসানদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন৷ ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে ক্ষুধা, তৃষ্ণা নিবারণে এগিয়ে এসেছেন তাঁরা৷ অনেকেই নিজেদের ঘরের দরজা পর্যন্ত খুলে দিয়েছেন৷ দীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তি দূর করতে এগিয়ে দিয়েছেন জল এবং খাবার৷ রাতভর রাজপথে তাঁদের সেবাযত্ন করেছেন৷ রক্তমাথা পায়ে ওষুধের প্রলেপ দিয়েছেন৷ নিজেরা উদ্যোগী হয়ে তাঁদের জন্য জুতো-চটি কিনেছেন, যাতে ফেরার পথটা সুগম হয়৷ আন্দোলনকারীদের প্রতি এহেন সহমর্মিতা বহু যুগ দেখেনি ভারত৷ আর বাণিজ্য নগরীর মানুষ যে এতটা মানবিক হতে পারেন, তা এর আগে কখনও ভাবতেও পারেননি মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই খেটে খাওয়া মানুষেরা৷
‘অল ইন্ডিয়া কিসান সভা'-র জাতীয় স্তরের নেতা হান্নান মোল্লার কথায়, ‘‘ত্রিপুরার মতো রাজ্যে বাম সরকার নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর কেউ কেউ বামপন্থিদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ কিন্তু জেনে রাখা ভালো যে, অভুক্ত মানুষ যতদিন থাকবে, গরিব মানুষ যতদিন থাকবে, ততদিন বামপন্থিরা থাকবে৷ আন্দোলন থাকবে৷ এই ভাবেই দাবি আদায় করে নেবে বামপন্থিরা৷ মহারাষ্ট্রের আগে ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়ের কৃষক সভা একইভাবে আন্দোলন করেছে৷ মহারাষ্ট্রে সরকারের কাছে বহুবার দাবি জানানো হয়েছে৷ সরকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে৷ কিন্তু মোদী সরকারের মুখ ও মুখোসের ফারাক বুঝতে দেরি করেনি কৃষকরা৷ তাই একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমে সরকারকে বাধ্য করা হয়েছে কৃষকের দাবি মেনে নিতে৷''
বিশিষ্ট সাংবাদিক ভোলানাথ ঘোড়ই মনে করছেন, ‘‘মহারাষ্ট্রের লং-মার্চ সারা পৃথিবীকে আন্দোলন শিখিয়ে দিলো৷ খুব সম্প্রতি ভারতে কিছুটা রাজনৈতিক পথ পরিবর্তন হয়েছে৷ তারপর বামপন্থা ধ্বংস হয়ে গেল, মন একটা প্রচার চলছিল৷ অন্যদিকে, গত কয়েক বছর ধরে অতি ডানপন্থি শক্তি অর্থবলের সঙ্গে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা চলছে৷ কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেল, প্রকৃত ক্ষিদের আন্দোলন হলে সাম্প্রদায়িকতা বানের জলের মতো ভেসে যায়৷ দু-এক জায়গায় লেনিনের মূর্তি ভেঙে মানুষকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না৷''
অন্যদিকে, অতীতে এমন শৃঙ্খলাপরায়ণ ও সমাজের অন্যান্যদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে নিজেদের দাবি আদায়ের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ খুব একটা নেই৷ দেশজুড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে৷ তাই পরীক্ষার্থীদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য দিনের বেলায় পথ দখল না করে আজাদ ময়দানে রাত কাটান কৃষকরা৷ তারপর সারারাত ধরে পথ হাঁটা৷ গরিব, নিপীড়িত কৃষকদের এই সামাজিক চেতনা দেখে অভিভুত মুম্বইবাসীও৷ রক্তঝরা পা-গুলোর সেবাযত্ন করতে এগিয়ে এলো অর্ধেক মুম্বই৷
সে এক অদ্ভুত দৃশ্য৷ আইআইটি বম্বের ছাত্ররা সেখানে আন্দোলনকারী কৃষকদের জন্য খাবার দাবার নিয়ে হাজির হলেন৷ কৃষকদের জন্য জুতো নিয়ে হাজির হয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷
শেষমেশ সেই ক্ষণ এলো৷ কৃষক সভার দাবিকে স্বীকৃতি দিল মহারাষ্ট্রের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার৷ ছ'মাসের মধ্যে কৃষকদের নামে জমি হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ নিজেই৷ মকুব হলো ঋণ৷ এক ঐতিহাসিক জয়ের সাক্ষী থাকলো মুম্বই৷ হস্তান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকর করতে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে দিলেন ফড়নবিশ৷ সরকারের প্রতিশ্রুতিতে সম্মান দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করলেন কৃষকরা৷
যদিও কষকসভার দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না৷ তবুও মহারাষ্ট্র বিধানসভায় দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ বললেন, ‘‘প্রথমদিন থেকেই কৃষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে৷ আমরা তাঁদের সব দাবি শুনেছি এবং যাবতীয় অভিযোগ দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাব৷''
ঘরে বাইরে এই ষাঁড়াশি আক্রমণের মধ্যে ছিলেন তাঁরা৷ শিবসেনা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কৃষকসভার৷ এমনকি কংগ্রেসও সমর্থন জানিয়েছিল তাঁদের৷ ভারতের ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম কোনো বামপন্থি সংগঠনের আন্দোলনের শরিক হয়েছিল বিজেপির শাখা সংগঠন এবং কংগ্রেস৷ সোমবার সকালেই কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী টুইটে লিখেছিলেন, ‘‘ইগো ছেড়ে মাটির মানুষের কথা ভাবুন ফড়নবিশ সরকার৷'' পালাবার কোনো পথ ছিল না বিজেপির৷ বাম কৃষক সংগঠনের বিপুল জনমর্থনের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারকে৷
‘সারা ভারত কৃষক ক্ষেত মজুর সংগঠন' শুরু থেকেই আন্দোলকে সমর্থন করেছিল৷ সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর ঘোষ বললেন, ‘‘এই আন্দোলন আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দেবে৷ কৃষক যদি রুখে দাঁড়ায় তাহলে শাসককে নতি স্বীকার করতেই হয়৷ অতীতে বাংলায় সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম এমন আন্দোলন দেখিয়েছে৷ ভবিষ্যতে পুঁজিবাদীদের আবারও এইভাবেই পরাজিত হতে হবে৷''
মহারাষ্ট্র বিধানসভায় দফায় দফায় কৃষক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁদের কথা শুনেছেন৷ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু কৃষকনেতারা তাঁদের জমির অধিকার ছাড়তে রাজি হননি৷ রক্ত জল করা শ্রম দিয়ে যে জমিতে ফসল ফলান, সেই ফসলেই অন্ন সংস্থান হয় রাজ্যবাসীর৷ তার জমিকর অধিকারটুকুই শুধু নিজেদের করতে চেয়েছিলেন তাঁরা৷ দিনের শেষে জয় হয়েছে তাঁদেরই৷ আরব সাগরের পাড়ে সূর্য ডুবলেও৷ কৃষক আন্দোলনের নতুন সূর্য উদয় হলো এখানেই৷
ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই আমরা৷ তাই লিখুন নীচের ঘরে৷