দমন পীড়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতি
২৭ ডিসেম্বর ২০১৯তারা মোটা দাগে বাংলাদেশের শাসকদের দুই ভাগে ভাগ করেন, শামরিক শাসক এবং নির্বাচিত৷ এই দুই ধরনের শাসকেরাই দমন পীড়নে রাষ্ট্রযন্ত্রকে যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি তাদের দলকেও ব্যবহার করেছেন৷
বাংলাদেশের এই প্রজন্মের তরুণেরাও মনে করে রাজনৈতিক দমন পীড়নের সাংস্কৃতি সব পর্যায়েই ছড়িয়ে পড়েছে৷ এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এর বাইরে নয়৷ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে পেশিশক্তির প্রদর্শন করে৷ কেন তারা এটা করে? এই প্রশ্নের জবাবে নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থী মঞ্চের সাবেক সমন্বয়ক এবং ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আবু রায়হান বলেন, ‘‘ছাত্ররাই সাধারণত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে৷ তাই এই প্রতিবাদী শক্তিকে তারা দমিয়ে রাখতে চায়৷ এটা তারা করে তাদের মূল রাজনৈতিক শক্তির স্বার্থে৷'' তিনি বলেন, ‘‘যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্র সংগঠন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন পীড়ন চালিয়ে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখে৷''
বাংলাদেশে দুইজন সামরিক শাসক ছিলেন৷ ক্ষমতায় থাকাকালে তারা রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার মনে করেন, ‘‘জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ দুজনই ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাজনৈতিক দমন পীড়ন চালিয়েছেন৷'' এর বাইরে যারা নির্বাচিত তারাও দমন পীড়ন করেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন৷ রাজনীতির এই চরিত্রের প্রধান দু'টি কারণকে তিনি চিহ্নিত করেন৷ প্রথমত, যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার পরিবর্তে দমন পীড়নের মাধ্যমে মেকাবেলা করে৷ দ্বিতীয়ত, বিরোধীদের রাজনীতির ধরন ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সহিংসতার সুযোগ করে দেয়৷
বাংলাদেশে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসে৷ কিন্তু মেয়াদ শেষে এই দলটি একক নির্বাচনের দিকে চলে যায়৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে তারা বিরোধীদের দমন পীড়ন করে৷ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচিত হয়ে আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটায়৷ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এখন টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অব্যাহতভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দমন পীড়নের অভিযোগ করছে৷ দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন৷
অন্যদিকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল৷ এই হামলা চালানো হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়৷ শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও নিহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী৷
রাজনৈতিক দমন পীড়নে শুধু রাষ্ট্রীয় নানা বাহিনী ও সংস্থাই নয়, আইন এবং কালা কানুনকেও ব্যবহারের অভিযোগ আছে৷ ওয়ান ইলেভেনের সময় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রী শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠায়৷ সামরিক শাসক এরশাদও এই দুই নেত্রী ও তাদের দলের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন পীড়ন চালায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী বাংলাদেশের রাজনীতিতে দমন ও সহিংসতা নিয়ে গবেষণাও করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা যদি নুরের (ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর) কেসটা দেখি তার ওপর নয়বার আক্রমণ হয়েছে৷ তার ওপর আক্রমণ এখন হালাল পর্যায়ে চলে গিয়েছে৷ সরকার যখন আমলে নিল তখন তার ওপর আক্রমনের প্রতিবাদ হলো, তার আগে নয়৷ এখন নুরের ওপর আক্রমণকে ছাত্রলীগও খারাপ বলছে৷ এটা দমন পীড়নের একটা উদহারণ৷ আর রাজনৈতিক দমন পীড়নতো ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত৷ অল্প সংখ্যক মানুষ মূল ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত৷ তাদের মেসেজ যা সেভাবেই চলে৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘এই দমন পীড়ন শুধু রাজনৈতিক নয়, এটা একটা সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে৷ এককভাবে রাজনৈতিক দমন বলে কিছু নেই৷'' তার মতে, ‘‘শুধু রাজনৈতিক নয়, গোটা ব্যবস্থার মধ্যেই দমন পীড়ন হয়৷ শিশুরা পরিবারে দমন পীড়নের শিকার৷ নারী নির্যাতন হচ্ছে, এটাওতো দমন পীড়ন৷ সামাজিক পরিসরে হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়৷ রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানে দমন হচেছ৷ মোটমুটি আমরা দমন পীড়নকে একটা গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে দিয়েছি৷ যে যার যোগাযোগের শক্তির মাধ্যমে দমন পীড়ন চালায়৷''
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে দমন পীড়নের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরেকটি রূপ প্রকাশ পায় রাজনৈতিক সহিংসতার মাধ্যমে, শক্তি প্রকাশের জন্য সব দলই এই কৌশল ব্যবহার করে আসছে৷ রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরেও আঞ্চলিক এবং ব্যক্তির ক্ষমতা রয়েছে৷ দলের মধ্যে ক্ষমতার নানা ভাগ আছে৷ ফলে এই সহিংসতা দুই দলের মধ্যে যেমন হয়, তেমনি একই দলের মধ্যেও হয়৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে গত ৬ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষে ৬৩৪ জন নিহত হয়েছেন৷ এই সময়ে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে তিন হাজার ৮৯৪টি৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷