তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার লড়াই
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮দাবি ছিলই৷ দাবি আরো জোড়ালো হলো৷ কিন্তু চিড়ে ভিজবে তো? এই প্রশ্নই এখন তুরস্কের বাতাসে ভাসছে৷ সম্প্রতি ইটালির এক বিখ্যাত খবরের কাগজে তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান রেচেপ তাইয়্যেপ এর্দোয়ানের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে৷ যেখানে তিনি বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবার তুরস্ককে জায়গা দেওয়া হোক৷
দাবি নতুন নয়৷ ২০০৫ সাল থেকেই এর্দোয়ান এই দাবি করছেন৷ তখন তিনি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী৷ কিন্তু কখনোই তাঁর দাবি ধোপে টেকেনি৷ বস্তুত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ হওয়ার জন্য ৩৫টি ধাপ রয়েছে৷ অভিযোগ, তার অধিকাংশই সফল ভাবে অর্জন করতে পারেনি তুরস্ক৷ অর্থনীতি থেকে পররাষ্ট্রনীতি, সর্বত্রই তাঁর সরকার অপারগ হয়েছে৷ কিন্তু এর্দোয়ানের দাবি ভিন্ন৷ তাঁর মতে, প্রতিটি ধাপই সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে তুরস্ক৷ কিন্তু ইউরোপের কোনো কোনো দেশের বিরোধিতার কারণেই তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে জায়গা পাচ্ছে না৷
কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল, আছে, থাকবে৷ ইতিমধ্যেই ইতালির রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর চাপ তৈরির কৌশলও গ্রহণ করেছেন এর্দোয়ান৷ কিন্তু তাতেই কি জল গলবে? এই উত্তর পেতে হলে খানিক ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো দরকার৷
তুরস্ককে রাজনৈতিক ভাবে খুব স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে দেখে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ দেখার কারণও নেই৷ দীর্ঘদিন ধরে সেখানে নানারকম জটিলতা অব্যাহত৷ যার অন্যতম কুর্দ সমস্যা৷ অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে কুর্দ বিদ্রোহীদের উপর হিংসাত্মক আক্রমণ চালিয়েছেন এবং চালাচ্ছেন এর্দোয়ান৷ এবং সে কাজে সফল হওয়ার জন্য তুরস্কে কার্যত এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছেন তিনি৷ সেখানে নির্বাচন হলেও এর্দোয়ানই সর্বেসর্বা৷ অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক জমি খুব মজবুত নয়৷ সমস্যা চরমে পৌঁছায় তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর৷ রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে সেখানে একদিনের অভ্যুত্থান হয়৷ অভিযোগ, নৃশংস কায়দায় তা দমিয়ে দেন এর্দোয়ান৷ বহু সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়৷ শুধু তাই নয়, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, নিজের ক্ষমতা জোরদার করতে এর্দোয়ানই ওই সেনা বিদ্রোহ করিয়েছিলেন৷
পাশাপাশি, তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর সঙ্গে লড়াইয়েও প্রথম দিকে এর্দোয়ানের ভূমিকা খুব স্পষ্ট ছিল বলে অনেকেই মনে করেন না৷ বস্তুত, আইএস-এর থেকে কুর্দদেরকেই বড় ‘থ্রেট' বলে তিনি মনে করেন বলে অনেকের ধারণা৷ যে কারণে, প্রথম দিকে সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের অস্ত্র দিয়ে এর্দোয়ান সাহায্য করেছিলেন বলে অভিযোগ৷ কারণ সে সময় কুর্দ বিদ্রোহীরা আইএস-এর সঙ্গে লড়াই করছিল৷ পরবর্তীকালে অবশ্য এর্দোয়ান আইএস বিরোধী শক্তির অন্যতম শরিক হন এবং ন্যাটো বাহিনীকে সাহায্য করেন৷ বস্তুত, আইএস-কে সাহায্য করার বিষয়টি তিনি কখনোই স্বীকার করেননি৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট৷
বিশেষজ্ঞদের দাবি আরো স্পষ্ট হয়েছে কারণ, সিরিয়ায় আইএস-এর শক্তি সামান্য কমতেই সেখানে কুর্দ বিদ্রোহী পিকেকে-এর বিরুদ্ধে সৈন্য অভিযান শুরু করেছেন তিনি৷ মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য সাধারণ মানুষের৷ যা নিয়ে ইউরোপের বহু দেশই কঠোর সমালোচনা করেছে৷ কিন্তু এর্দোয়ান পিছু হঠতে রাজি নন৷ বরং তাঁর যুক্তি, যে কোনো জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধেই অভিযান চালিয়ে যাবে তুরস্ক৷ কুর্দ বিদ্রোহীদের তাদের ভাষাতেই জবাব দিতে হবে৷ এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, যে সমস্ত দেশ জঙ্গিদের সমর্থন জোগায়, তিনি তাদের পাশে নেই৷ শুধু তাই নয়, এর্দোয়ানের দাবি ইউরোপের বহু দেশই পিকেকে-এর মতো সংগঠনকে জঙ্গি বলে মনে করে৷ সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে অন্য চোখে দেখা উচিত নয়৷
কিন্তু এর্দোয়ানের এই দাবির সঙ্গে বাস্তবের অনেক তফাত৷ কুর্দ সমস্যাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বলেই মনে করে ইউরোপ৷ এ বিষয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানসূত্র খুঁজে বার করার কথাও একাধিকবার বলা হয়েছে ইউরোপের দেশগুলির তরফ থেকে৷ কিন্তু ইরাক কিংবা তুরস্ক তা কখনোই মানতে রাজি হয়নি৷ অন্যদিকে, কুর্দ বিদ্রোহীরা যেভাবে আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তাকেও কুর্নিশ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ ফলে কুর্দদের বিরুদ্ধে এর্দোয়ানের অভিযান অধিকাংশ দেশই ভালো চোখে দেখছে না৷
সমস্যা রয়েছে আরো৷ তুরস্কের অর্থনৈতিক টালমাটালের জন্য বহু তুর্কি শরণার্থী ইউরোপের বহু দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এবং করছেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই বিষয়টিকেও খুব ভালো চোখে দেখে না৷ তুরস্ককে কোনো ভাবেই স্থিতিশীল রাষ্ট্র বলে মনে করতে চায় না তারা৷ এমন অবস্থায়, তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ হতে গেলে বহু বাধা পেরতে হবে৷ মন জয় করতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ রাষ্ট্রের৷ সম্প্রতি ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে তুরস্ক সম্বন্ধে ইউনিয়নের নেতাদের যে মনোভাব দেখা গেছে, তাতে তুরস্ক সকলের মন গলাতে পারবে, এ আশা দুরাশাই মনে হচ্ছে৷ সে কথা বুঝেই সম্ভবত, ইটালি, ফ্রান্সের মতো দেশের সাহায্য পেতে চাইছে তুরস্ক৷ তবে সেই কূটনীতিও ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞেরা৷