তিন বছরে ১৪ যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে হত্যা
১৬ অক্টোবর ২০২২তার স্বপ্ন মুছে গেছে৷ তার পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া৷
তবে এবারই প্রথম নয়৷ গত তিন বছরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বাসের চালক ও হেল্পাররা এরকম ১৪ জন যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী৷ তার কথা, ‘‘কোন ঘটনায় বিচার না হওয়ায় চালক ও হেলপাররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷” তিনি জানান ১৪ জন নিহত গেছেন, কিন্তু এই সময়ে বাস থেকে ফেলে দেয়া বা নামিয়ে দেয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে৷ আর প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় এই ঘটনাগুলো ঘটছে৷”
সায়েমের বাসা যাত্রাবাড়ি এলাকায়৷ তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সেখানে থাকতেন৷ শনিবার বিকালের পর তার কর্মস্থল মতিঝিলের নিট প্লাস লি.-এর অফিস ছুটি হলে তিনি মতিঝিল থেকে আট নম্বর বাসে করে যাত্রবাড়ির বাসায় রওনা হন৷ পথে ভাড়া বেশি চাওয়ায় প্রতিবাদ করেন তিনি৷ সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে বাসটি যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সরণি দিয়ে যাওয়ার সময় হেলপার আবু সায়েমকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়৷ এসময় পিছন থেকে আসা তুরাগ পরিবহণের একটি বাসের চাকা আবু সায়েমের মাথা থেঁতলে দেয়৷
ঘটনাস্থলেই আবু সায়েম নিহত হন৷ এই ঘটনায় অন্য যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হন৷ তারা বাসটি থামাতে বাধ্য করেন৷ একপর্যায়ে বাসের চালক শাহ আলম ও হেলপার মোহনকে আটক করে গণপিটুনি দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা৷ পুলিশ গিয়ে ওই দুইজনকে উদ্ধার করে৷ বিক্ষুব্ধ লোকজন আট নম্বর বাসটি ভাঙচুরের পর পুড়িয়ে দেয়৷
নিহত আবু সায়েমের বড় ভাই আবু সাদাত বলেন, ‘‘আমি সন্ধ্যার পর খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার ভাই মারা গেছেন৷ যারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তারা জানান, আমার ভাই বেশি ভাড়া নেয়ার প্রতিবাদ করলে তাকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়৷ আমি এই হত্যার বিচার চাই৷”
রোববার বিকালে ডয়চে ভেলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় তিনি লাশ নেয়ার জন্য হাসপাতালের মর্গে ছিলেন৷ কথা বলতে গিয়ে বার বার তার গলা ধরে আসছিল৷ এরমধ্যেই তিনি বলেন, ‘‘আমরা আমার ভাইয়ের বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলাম৷ এই সপ্তাহেই পাত্রী দেখার কথা ছিল৷ কিন্তু আমাদের সে আশা পূরণ হলো না৷” তার কথা , ‘‘এভাবে যদি বাস থেকে ফেলে দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয় তাহলে আমরা কোন দেশে আছি!”
তিনি জানান, চার ভাই-বোনের মধ্যে সায়েম ছিলেন তৃতীয়৷ তাদের বাবা মারা গেছেন৷ সংসারে সায়েমের উপার্জনও অনেক সহায়তা করত৷ এখন সবই শেষ হয়ে গেল৷
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘চালক-হেলপারদের এই অপরাধের বিচার হয় না৷ ফলে তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷ আমরা এর প্রতিবাদ করলে মালিকরা মামলার হুমকি দেয়৷ আর মালিক পক্ষের অতি মুনাফার লোভের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ তারা বাড়তি ভাড়া আদায় করতে মরিয়া হয়ে ওঠে৷ এ নিয়ে প্রতিদিনই যাত্রীদের সঙ্গে ঝামেলা হয়৷ আর চালক-হেলপাররা সংঘবদ্ধ হয়ে যাত্রীদের ওপর চড়াও হয়৷ গত তিন বছরে ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে এভাবে ফেলে দিয়ে ১৪ জন যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে৷”
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘এই চালক-হেলপারদের কোনো প্রশিক্ষণও দেয়া হয় না৷ তাদের বড় একটি অংশ আবার মাদকাসক্ত৷’’
এর জবাবেসড়ক পরিবহণমালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্ল্যাহ বলেন, ‘‘এই হত্যাকাণ্ডের আমরা প্রতিবাদ জানাই৷ বিচার দাবি করি৷ এরইমধ্যে চালক ও হেলপারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তাদের আইনে যা আছে তাই শাস্তি হবে৷”
তবে তিনি দাবি করেন, ‘‘চালকদের সঠিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব শুধু মালিকদের নয়, বিআরটিএ'রও দায় আছে৷ আর আমরা তো বাসে থাকি না৷ পথে তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাফিক পুলিশ আছে৷ আমরা তাদের মাদকমুক্ত রাখার জন্য ডোপ টেস্টের নিয়ম করেছি৷ এখন বিআরটিএ সেটা কীভাবে করছে তা তো বলতে পারব না৷”
যাত্রাবাড়ি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ইয়ামিন কবির জানান, ‘‘এই ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ মামলায় আটক চালক ও হেলপারকে আসামি করা হয়েছে৷ তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয়েছে৷ তদন্তে এই অপরাধে আরো কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় নেয়া হবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিক তদন্তে এটা নিশ্চিত যে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির কারণেই আবু সায়েমকে বাস থেকে ফেলে দেয়ার পর আরেকটি বাসের চাপায় সে মারা যায়৷ তবে এটা পরিকল্পিত না উত্তেজনার কারণে হঠাৎ ঘটেছে তা আমরা তদন্ত করে দেখছি৷”