মোদী সরকারের তিন বছর
২৪ মে ২০১৭মোদী সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় এসেছিল ২০১৪ সালে সুদিনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে৷ সেই সুদিনের প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করতে পেরেছেন তিনি? মোদী সরকারের তিন বছরের ‘রিপোর্ট কার্ড’ নিয়ে এক জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় ৪৯ শতাংশ মানুষ মনে করছে, তাঁদের জীবনযাত্রার গুণমানে কোনো পরিবর্তন অনুভব করতে পারছে না৷ প্রায় ১৫ শতাংশ মনে করছে, জীবনযাত্রার মান আরও নিম্নমুখী হয়েছে৷ সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ এই জনমত সমীক্ষা করে বলছে, মোদী সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে গরিব তেমনভাবে উপকৃত হয়নি৷ তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর উপরে সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬২ শতাংশ) জনগণ এখনও আস্থা হারায়নি৷ আগামি ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁরা মোদীকেই হয়ত আবার দেখতে চায় প্রধানমন্ত্রী পদে৷ লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল সুভাষ কাশ্যপের মতে, মোদীর ভাবমূর্তি এবং কাজকর্মের তারিফ করছেন বেশির ভাগ মানুষ৷ তাঁরা মনে করেন, বিশ্বে ভারতের নীতি ও অবস্থানকে আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন মোদী সরকার৷
অন্য শিবির বলছে, ২০১৪ সালে মোদী সরকার আসার পর সংঘ পরিবার সরকারি রক্ষাকবচের আড়ালে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেশ জুড়ে৷ উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রহসনে পরিণত করছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থানগুলির উপর চডাও হচ্ছে যখন তখন৷ তকমা সেঁটে দিচ্ছে হিন্দু-বিরোধী তথা রাষ্ট্রবিরোধীর৷ তারই জেরে গণপিটুনি একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এই তো, গত সপ্তাহেই ঝাড়খন্ডে পুলিশের চোখের সামনেই গণপিটুনির মর্মান্তিক শিকার হয় নয় জন৷ তারমধ্যে জনা পাঁচেক মুসলিম গরু ব্যবসায়ী৷ বিজেপি এবং তার সহযোগী দল একান্ত নিজস্ব দুটি কর্মসূচি হাতে নেয়৷ একটি ‘লাভ-জেহাদ’, যাকে বলা হয়ে থাকে, রোমিও-স্কোয়াড, অন্যটি গো-রক্ষক বাহিনী৷ এদের প্রধান কাজ স্থানীয় লোকজনদের ক্ষেপিয়ে তাৎক্ষণিক ফয়সালা করা৷ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে হিন্দু মেয়েদের মুসলিম যুবকদের হাত থেকে রক্ষা করার নামে এবং গরু ব্যবসায়ী বা পাচারকারীদের হাত থেকে গো-মাতাকে বাঁচানোর নামে ত্রাসের সঞ্চার করে এরা৷ এটা নিছক আইন শৃংখলার প্রশ্ন নয়৷ মোদী সরকার বা তাঁর গৈরিক দলের পরোক্ষ সমর্থনেই এইসব কান্ড-কারখানা বেড়ে চলেছে৷ কয়েকদিন আগে একটি হিন্দু মেয়ে এক মুসলিম প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেলে সেই মুসলিম পরিবারের অভিভাবকে নির্মভাবে মারধর করা হয়৷ অথচ মোদী সরকার সব দেখেও যেন না দেখার ভান করে আছে৷ এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর অবস্থানও বিভ্রান্তিকর৷
মোদী সরকারের তিন বছরের রিপোর্ট কার্ড সম্পর্কে প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডক্টর অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘মোদী সরকারের যতটা গর্জন আছে, ততটা বর্ষণ নেই৷ বিকাশ হার বলে যেটা দেখানো হচ্ছে, সেটা শুধু পরিষেবা ক্ষেত্রে, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের নয়৷ কাজেই সেটাকে সাফল্য বলা চলে না৷ দেশের দু’টি প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য ও বেকারত্ব৷ এই দুটি ক্ষেত্রেই মোদী সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ৷ দুই কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কার্যত হয়েছে মাত্র কয়েক লক্ষ৷ অন্যদিকে সহিষ্ণুতার অভাব গত তিন বছরে বারংবার চোখে পড়েছে, যেটা গণতন্ত্রের বিপদের কারণ৷ কাশ্মীর ইস্যুর অগ্রগতি হয়নি ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতির কারণে৷ কাশ্মীরিদের কাছে মোদী সরকার তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে৷ শক্তি প্রয়োগে কাশ্মীর ইস্যুর হাল হবে না, হবে আলোচনায়৷ আর সেক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ডাকা দরকার৷ কিন্তু পাকিস্তানসহ নিকট প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনুকূল নয়, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে৷’’
তবে ডক্টর মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘মোদীর ভাবমূর্তি জনমানসে এখনো উজ্জ্বল৷ ‘মন কী বাত’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মোদীর সরাসরি জনসংযোগ প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই৷ তাতে রাজনৈতিক দিক থেকে লাভবান হয়েছে তাঁর ‘পদ্মদল’৷ তার ফলেই সাম্প্রতিক কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মোদীর বিজেপি ক্ষমতাসীন হতে পেরেছ৷ দেশের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশও রয়েছে সেই তালিকায়৷’’ তবে তিনি মনে করেন, মোদী সরকারের এই তিন বছরে সামগ্রিকভাবে দেশের খুব একটা উন্নতি হয়নি৷
অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের এক শিক্ষক কিংশুক মজুমদার কিন্তু মোদী সরকারকে দিয়েছেন ফুলমার্কস৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আর্থিক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ (এফডিআই) উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে৷ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে চলেছে বিপুল কর্মযজ্ঞ৷ সড়ক, রেল, সেতু, বন্দর প্রকল্পের কাজ চলেছে ব্যাপকভাবে৷ দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, এটা মানা যায় না৷ শেয়ার বাজারের দিকে তাকান৷ সেখানে সূচক উর্ধগামী৷ এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি এখন ভারত৷ বিমুদ্রাকরণের মাধ্যমে কালো টাকা রাতারাতি খতম করা সম্ভব নয়৷ মোদী সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেটাই বড় কথা৷ আগেকার সরকার এ পদক্ষেপ নেয়নি৷’’
প্রধানমন্ত্রী মোদীর জনপ্রিয়তা এবং তিন বছরের কথিত সাফল্যকে কাজে লাগাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে বিজেপি৷ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে কংগ্রেস এবং সহমতাবলম্বী দলগুলি মোদী সরকারের তিন বছরের ব্যর্থতা তুলে ধরতে প্রচার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে৷ বিজেপির সাফল্যের বড় পরীক্ষা আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং বলা বাহুল্য, ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন৷ পর্যবেক্ষকদের একাংশের জল্পনা, রাষ্ট্রপতি নির্বচনে যদি বিজেপি মনোনীত কেউ প্রাথী জয়ী হন, তাহলে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আনতে পারে বিজেপি৷