‘তিন ধর্ষককে ধরতে সহায়তা করুন’
৮ মে ২০১৭গত ২৮ মার্চ জন্মদিনের পার্টিতে দাওয়াত করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে নিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয়৷ হোটেলের একটি কক্ষে নিয়ে রাতভর তাদের আটকে রেখে মারধরও করা হয়৷ মামলায় বলা হয়েছে, আসামিদের অপর তিনজন ধর্ষণে সহায়তা ও ভিডিও ধারণ করেন৷ হুমকির কারণে এতদিন মামলা করতে ভয় পাচ্ছিলেন ঐ দুই নারী৷ আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রথমে মামলা নিতে চায়নি পুলিশ– এমন অভিযোগও রয়েছে৷ এই ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা’ নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে আবারও৷
সাংবাদিক প্রভাষ আমিন লিখেছেন, ‘‘নারীদের ভদ্রতাকে পুরুষদের কেউ কেউ দুর্বলতা ভাবেন৷ বনানীর ঘটনায় বলা হচ্ছে, মেয়ে দুটি হোটেলে গেল কেন? আরে ভাই, মেয়ে দুটি আপনার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেছে, ধর্ষিত হতে নয়৷ আমাদের অনেকেই মনে মনে ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ সুযোগ পেলেই নারীর স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে দেন৷ মনে রাখবেন, নো মিনস নো৷ আপনি বুঝতে না পারলে সেটা আপনার সমস্যা৷ আপনি যদি আপনার উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারেন, তাহলে আপনি মানুষ নন– পশু৷’’
তিনি আবারও বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত আইনের বিষয়টির উল্লেখ করেছেন এখানে৷ লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় সবচেয়ে বড় অন্যায়টা হলো, ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে৷ যার থাকার কথা কারাগারে, সে যায় বাসর ঘরে৷ ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে, কেউ একজন কোনও একজন সুন্দরীকে টার্গেট করবে, পাত্তা না পেলে তাকে ধর্ষণ করবে এবং আরামসে বিয়ে করবে৷ এ অন্যায়, ভারি অন্যায়৷ এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে৷’’
সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, অধিকার কর্মীদের পাশাপাশি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমও এ সংক্রান্ত সংবাদ শেয়ার করে ফেসবুকে আসামিদের ছবি শেয়ার করার আহ্বান জানিয়েছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘আপনারা যারা সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, বিল্লাল হোসেন, সাদনান ও সাকিফ কে চেনেন, তারা দয়া করে বনানী থানায় বিস্তারিত জানান এবং ছবি প্রকাশ করুন যেন অন্য কেউ তাদের খোঁজ দিতে পারে৷ এরাই অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের ধর্ষণ করেন বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন দুই ছাত্রী৷’’
তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই আসামিদের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন৷
তানবীর সিদ্দিকী অবশ্য মামলা নেয়ার বিষয়ে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘‘বনানী থানা কি বাংলাদেশের বাইরে! না.... মানে ধর্ষণ মামলা নিতে ৪৮ ঘণ্টা লাগালো তো তাই বলছি৷’’
মাহবুবুল আলম আসামিদের প্রভাব প্রতিপত্তির দিকে আঙুল তুলেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘ধর্ষণকাণ্ডের পর দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর অভিযোগ নিতে থানা-পুলিশের সময় লেগেছে ‘৪৮ ঘণ্টা’, কারণ, প্রধান আসামির বাবা যে দেশের অন্যতম স্বর্ণ ব্যবসায়ী৷ অন্যদের বাবারাও অনেক ক্ষমতাশালী৷ স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ক্ষমতার সংযুক্তিতে ২৫ লাখ টাকা ‘ঘুষ’ নিয়েও শেষ পর্যন্ত বনানী থানা পুলিশ মামলা নিতে বাধ্য হয়েছে৷ যার মামলা নম্বর আট৷ এর মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত সাফাত আহমেদ আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে৷ বাকি দু’জনের মধ্যে একজন প্রভাবশালী এক নেতার ছেলে, অন্য জনের পরিচয় জানা যায়নি৷ সাফাতের ড্রাইভার বিল্লাল ও দেহরক্ষীকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে৷’’ সুদীপ্ত বিশ্বাস ঐ নারীদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন ফেসবুকে, যেখানে তারা বলেছেন, ‘‘সাফাত তাদের মোবাইলে ফোন করে বলে– তোরা বিষয়টি ভুলে যা৷ পুলিশ, র্যাবকে জানালে তোদের অনেক ক্ষতি হবে৷ লাশ খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ তোদের মতো এমন অনেকেই হারিয়ে গেছে৷ কিন্তু আমরা চাই না আর কোনো নারী ওদের হাতে এ রকম নির্যাতনের শিকার হোক—তাই পুলিশের কাছে গিয়েছি৷’’
মুক্তাদীর হুসেইন ফেসবুকে আপন জুয়েলার্স এর মালিকের উক্তি তুলে ধরেছেন৷ সেখানে ধর্ষকের পিতা বলেছেন, ‘‘ওই রাতে যদি কিছু হয়েও থাকে, তাহলে সমঝোতার ভিত্তিতেই হয়েছে৷’’ মুনমুন শারমীন শামস লিখেছেন, ‘‘বঙ্গদেশের অহংকার- পুরুষদের তেজের প্রতীক- সাফাত আর নাঈম- দুই বীর ধর্ষক৷ আসুন এদের মাথায় তুলে নৃত্য করি৷ এরা একজন আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে৷ অন্যজন এমন এক সরকারি দলনেতার ছেলে, যার বাপের নাম আমরা মুখে আনতে পারছি না, কারণ, জাতির বিবেকরা কেউ সেই নাম কোথাও লেখেনি৷’’
শহীদ বুদ্ধিজীবির সন্তান ডা. নুজহাত চৌধুরী অবশ্য ধর্ষণের নারীদের ছবি বা তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ না হওয়াটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখে লিখেছেন, ‘‘এই প্রথম কোনো পত্রিকা অথবা ফেসবুকে ধর্ষিতার নাম বা ছবি কেউ দেয় নাই৷ দিয়েছে ধর্ষকের নাম ও ছবি৷ একজন নির্যাতিতার পরিচয় বা ছবি প্রকাশ করে তাকে আবারও সামাজিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয় এবং ভবিষ্যতে তার স্বাভাবিক জীবন গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়া হয়৷ এই সামাজিক হেনস্তার ভয়ে নির্যাতিতা নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হন না, এমনকি প্রতিবাদ করতেও ভয় পান৷ আশা করি, খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা দায়িত্বশীল আচরণ বজায় রাখবো - তা পত্রিকাতেই হোক আর ভার্চুয়াল জগতেই হোক৷’’
ইমতিয়াজ মাহমুদ নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর কথা বলেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষা দেন যে নারী পুরুষ দুইই মানুষ৷ নারী মানুষ হিসাবে পুরুষের অধীন না বা পুরুষের ভোগের বস্তু না৷ ছেলেমেয়েদেরকে শেখাতে হবে, একজন যখন বলে ‘না’, তখন থামতে হবে৷ পরিবারে আপনি যখন নারী শিশুটিকে নারী করে তোলার জন্যে নারীসুলভ শিক্ষা দিচ্ছেন, ঢেকেঢুকে রাখতে হবে, সতীত্ব চলে যাবে, নষ্ট হয়ে যাবে ইত্যাদি, তখন কিন্তু আপনি আপনার পরিবারের ছেলে শিশুটিকে শেখাচ্ছেন যে, ওর বোনটিও নিতান্তই একটি ভোগের বস্তু৷ আমরা শেখাচ্ছি, ধর্ষণের শিকার হলে নারীটি নষ্ট হয়ে গেল৷ ... আমরা কেন শেখাচ্ছি না যে, ধর্ষণের শিকার মেয়েটি কোনোভাবেই নষ্ট হয়ে যায় না? এই কথাটা শেখানো কি খুবই কঠিন যে, নারী কোনো ফল না বা খাবার না যে নারী নষ্ট হবে? নারীও মানুষ৷’’
সংকলন: অমৃতা পারভেজ
সম্পাদনা: আশীষ চক্রবর্ত্তী