তিন ঘণ্টা বৃষ্টিতেই হাঁটুপানিতে ঢাকা
১ জুন ২০২১সকাল ছয়টা থেকে ৯টা পর্যন্ত এই তিন ঘণ্টা ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে৷ আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে এই মৌসুমে এটা সর্বোচ্চ বৃষ্টির রেকর্ড হলেও সামনে আরো বেশি বৃষ্টি হবে৷ কিন্তু এই বৃষ্টিতেই পুরো ঢাকা শহর ডুবে যায়৷ আর বৃষ্টির এই পানি নামতে সময় লাগে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা৷ আর ঢাকার নিম্নাঞ্চলের পানি এখনো সরেনি৷
কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আবুল হোসেন জানান, সকালে তাদের কাঁচাবাজার পুরোটাই বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়৷ তখনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কাঁচামাল তারা ট্রাক থেকে নামাচ্ছিলেন৷
হাফিজুর রহমানের সাথে দুপুরে দেখা হয় হাতিরঝিলে৷ তার বাসা রামপুরা এলাকায়, অফিস মাতিঝিলে৷ তিনি জানান, রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় তিনি অনেক কষ্টে ওয়াটার ট্যাক্সিতে করে কারওয়ান বাজার হতিরঝিলে আসলেও মতিঝিল যেতে পারেননি৷ দুপুরে আবার ওয়াাটার ট্যাক্সিতে করেই বাসায় ফেরার চিন্তা করছিলেন৷
ঢাকার মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, গুলশান, ধানমন্ডি, মিরপুর, কল্যাণপুর, শান্তিনগর, মাগবাজারসহ কোন এলাকা বৃষ্টিতে ডোবেনি? যাত্রাবাড়ি, মুগদা, বাড্ডা, মেরাদিয়াসহ বিভিন্ন এলকা যেন নদীতে পরিণত হয়৷ ওইসব এলাকার কাঁচা বাড়িঘর আর ভবনের নিচতলা পানির নিচে চলে যায়৷ রিকশাসহ কোনো ধরনের যানবাহন ৫-৬ ঘন্টা চলচল করতে পারেনি৷ কোথাও কোথাও নৌকা চলতে দেখা গেছে৷
স্যুয়ারেজের ময়লা আবর্জনাযুক্ত ওই ময়লা পানিতে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন নগরবাসী৷
তবে এই বৃষ্টির পানির ‘ভয়াবহতায়' আবারো সামনে চলে এসেছে ঢাকার খাল৷ উত্তর ঢাকার মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, খালগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে ফেলায় বৃষ্টির পানি সরতে পারছে না৷ দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস খাল উদ্ধারে নামলেও তিনি সফল হননি৷ তিনি এক সপ্তাহ আগেও বলেছিলেন, খাল উদ্ধার করার পর এবার নাগরিকেরা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবেন৷ ঢাকায় এখনো কাগজে কলমে ২৭টি খাল আছে৷ এক সময় ছিলো ১১৭টি৷
বৃষ্টির পানি দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা না থাকলে সেটা জমবেই৷ এই দায়িত্ব নিয়েও আছে নানা টানা হেঁচড়া৷ ওয়াসা এর দায়িত্ব দিতে চায় দুই সিটিকে৷ খাল ছাড়াও এই বৃষ্টির পানি সরাতে আছে দুই হাজার ৫০০ কি.মি. খোলা ড্রেন এবং চার হাজার কি.মি. ভূগর্ভস্থ ড্রেন৷ কিন্ত এসব ড্রেন পরিস্কার থাকে না ৷ ৪০ ভাগেরও বেশি ময়লা জমে থাকে৷ আর ঢাকায় প্রতিদিন ১৫ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদিত হয়৷ যার বড় একটি অংশ এইসব ড্রেনে যায়৷
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘‘জুরাইন খালের মুখ বন্ধ আছে ফলে পানি সরতে পারে না৷ ড্রেন যতই পরিষ্কার করেন কাজ হবেনা৷ পশ্চিমের পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্পগুলোর অর্ধেকই অচল৷ দক্ষিণ আর উত্তরের পাম্পগুলোও শতভাগ কার্যকর নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেমও অকার্যকর হয়ে পড়েছে৷ হাতিরঝিলে বৃষ্টির পানি নেয়া যায়৷ কিন্তু হাতিরঝিলের সব গেট খুলে দিলে ড্রেনের পানিতে ভয়াহ দুর্গন্ধ সৃষ্টি হবে ওই এলাকায়৷ গত ১০ বছর ধরে পরিকল্পনা, মহা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো কাজই হয়নি৷'' আর হাতিরঝিলের চাপ নেয়ার ক্ষমতাও অত নেই৷ এদিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য স্ট্রম ড্রেনেজের কাজও এগোচ্ছে না৷
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যনার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘‘আসল সমস্যা হলো আমাদের নগর পরিকল্পনায়৷ আমদের মত বৃষ্টিবহুল এলকায় ঢাকা শহরের মত জায়গায় ২০-২৫ ভাগ সবুজ এলাকা এবং ১০-১২ ভাগ, সব মিলিয়ের কমপক্ষে ৩০-৩৫ ভাগ ওয়াটার বডি থাকতে হয়৷ এই সব ফাঁকা জায়গা থাকলে পানি সেখানে যেত৷ কিন্তু ঢাকায় কংক্রিটের স্থাপনা ৮৫ ভাগের মত৷ ফলে ৯০ ভাগ পানি ড্রেনে চাপ সৃষ্টি করে৷ যে চাপ নেয়ার মত ড্রেনের নাই৷ ফলে জলাবদ্ধতা অনিবার্য৷''
তিনি বলেন এর বাইরে অনেক এলাকায় রাস্তাঘাট উঁচু করা হয়েছে৷ কিন্তু স্থাপনা নিচুই আছে৷ ফলে জলাবদ্ধতা হয়৷
ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান দেশের বাইরে আছেন৷ তিনি কয়েক বছর আগে ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘ স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি৷ এটা আসলে কিছুটা মনুষ্যসৃষ্ট এবং কিছুটা প্রয়োজনেই হয়েছে৷ ঢাকা একটা আনপ্ল্যানড সিটি৷ এখানে মানুষকে বসবাসের সুযোগ দিতে গিয়ে আমরা যা করেছি, তা প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেছে৷''