দেশে যাওয়া হবে না?
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫যে ছবির কথা বলছি, কপিরাইট না থাকায় সেটি এই ব্লগ পোস্টে করতে পারছি না৷ তবে ছবিটা আমাকে এভাবে আকর্ষণ করার সম্ভবত আরো একটি কারণ আছে৷ আমারও একটা মেয়ে আছে৷ বয়স মাত্র দেড় বছর৷ এখনই বেশ বাবা ভক্ত হয়ে উঠেছে সে৷ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার সঙ্গে নাস্তা করে, রাতে বাবা ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে৷
জানি, অনেক বাবার সন্তানরাই এমনটা করে৷ অভিজিতের মেয়ে তৃষাও নিশ্চয়ই এমনটা করত৷ করত মেঘও, যার বাবা-মা খুন হয়েছে তিন বছর আগে৷ মেঘ তাঁদের রক্তাক্ত মরদেহ বেডরুমে পড়ে থাকতে দেখেছে৷
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে৷ তাই না চাইতেও সাগর কিংবা অভিজিতের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করছি কিছুক্ষণ পর পর৷ রক্তের মাঝে নিথর পড়ে আছে একজন মানুষ৷ ভাবছি তাঁর সন্তানের কথা৷ আর সেই ভাবনা এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করছে৷ তাহলে কি দেশে বেড়াতে যাওয়াও এবার বন্ধ করে দিতে হবে?
সাংবাদিকতা করি, অনেক ব্লগারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত৷ কাজের সূত্রে, ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে চেষ্টা করি বিপদে ব্লগারদের পাশে দাঁড়াতে৷ যে ‘‘আনসার বাংলা সেভেন'' আজ অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করেছে, তাদের টুইটারে রিটুইট করা টুইটগুলোর মধ্যে আমার টুইটও আছে৷ ফেসবুকে মাঝেমাঝে কেউ কেউ সাধাসিধে প্রশ্ন করে, কবে আসবেন দেশে? বুঝি নজর রাখা হচ্ছে৷ তবুও সেসব প্রশ্নের উত্তর স্বাভাবিকভাবে দিয়ে এসেছি এতদিন৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো ফাঁদ পাতা হচ্ছে না তো?
মনের মধ্যে এত অজানা আশঙ্কা দেখা দিত না, যদি দেখতাম যে খুনিরা ধরা পড়েছে৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যত কোনো মিল নেই৷ তবে দু'টো ঘটনারই শিকার সাংবাদিক, ব্লগাররা – মুক্তভাবে মত প্রকাশ যাঁদের দায়িত্ব, অধিকার৷ গত তিন বছরে খুন হয়েছেন ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার৷ গুরুতর আহত হয়েছেন আসিফ মহিউদ্দিন৷ আর সবই ঘটেছে আমার অতি পরিচিত ঢাকা শহরে৷
রাজিব হায়দার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি এখনো, আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলাকারীদের শাস্তিও হয়নি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ‘মোটিভ'-ই এখন প্রর্যন্ত অজানা৷ আর অভিজিৎ হত্যা তো এখনো নতুন একটা ঘটনা৷ তারপরও খুনিদের গ্রেপ্তারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই৷
এ সব হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া আমার মতো প্রবাসীদের মনে ক্রমশ ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে৷ গতকালই ফেসবুকে দেখছিলাম ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিঝুম মজুমদারের স্ট্যাটাস৷ লন্ডনে বসবাসরত এই ব্লগার লিখেছেন তাঁর মায়ের কথা৷ সন্তান বিদেশে, দূরে থাকায় তাঁর মায়ের মন ভালো থাকে না৷ কিন্তু তবুও তিনি চান না সন্তান দেশে ফিরে আসুক৷ মা বোঝেন দেশটা আর নিরাপদ নেই৷ সন্তান তাই দূরে আছে, থাকুক, ভালো তো আছে, নিরাপদ তো আছে৷ এটাই মায়ের সান্ত্বনা৷ নিঝুমের মায়ের মাঝে আমার নিজের মাকেও খুঁজে পাই৷
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, সরকার এ সব খুনের বিচারের বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী নয়৷ জামাত-শিবির নিধনে সরকার যতটা তৎপর, ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে ততটা তৎপর নয়৷ বিশেষ করে ব্লগারদের, সাংবাদিকদের হত্যাকাণ্ডের বিচারে তাদের অনীহা বেশ স্পষ্ট৷
সরকারের এই অনীহা আমার মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা আতঙ্ককে যেন আরো পাকাপোক্ত করছে৷ দেশের প্রতি টান, ভালোবাসার সঙ্গে নিরাপত্তাহীনতার এক লড়াই শুরু হয়েছে৷ এই লড়াইয়ে একসময় নিরাপত্তাহীনতা টিকবে না জানি৷ যে দেশে জন্ম, সে দেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হতে দেবো না৷ তাই দেশে যাওয়াও থামবে না৷ শুধু প্রত্যাশা, সরকার আরো সচেষ্ট হোক, খুনিদের বিচার করুক৷ এটার যে এখন খুবই প্রয়োজন৷