তালেবানরা কি আফগানিস্তানের অর্থনীতি সামলাতে পারবে?
২৯ আগস্ট ২০২১ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে জমা থাকা আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড় না করার নির্দেশ দিয়েছেন বাইডেন ও মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আফগানিস্তানের নয়শ কোটি ডলারের সম্পদ জমা আছে। এর মধ্যে রয়েছে ১২ লাখ ডলারের স্বর্ণ আর ত্রিশ কোটি ডলার সমমূল্যের আন্তর্জাতিক মুদ্রা।
এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে মারাত্মক তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। সেই সাথে জিনিসপত্রের দাম আস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান আজমল আহমাদি এক টুইট বার্তায় জানান, আফগানিস্তানে এই মুহূর্তে ক্যাশ টাকা নেই বললেই চলে। আর স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ মুদ্রা জমা আছে তা দেশ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী মারাত্মক পরিস্থিতির শিকার হবে বলে জানান আহমাদি।
কাবুল দখলের পর তাই দেশের আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি তালেবানরা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ভিত্তি কতটা তৈরি করতে পারবে সে বিষয়ে সন্দেহ বিশেষজ্ঞদের।
আফগানিস্তানের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি
বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা তিন কোটি ৯০ লাখ। সহজ করে বলা যায়, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের একভাগ৷
২০ বছর ধরে সংঘাতে লিপ্ত দেশটির কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের প্রয়োজন মেটাতে যে শিক্ষাব্যবস্থার দরকার সেটিও নড়বড়ে৷ জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে সাক্ষরতার হার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৩ভাগ৷
নারী ও শিশু শিক্ষায়ও বেশ পিছিয়ে দেশটি৷ ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান বলছে, দেশটিতে বর্তমানে ৩৭ লাখ শিশু রয়েছে যারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত৷ এ শিশুদের শতকরা ৬০ভাগ মেয়ে বলে জানায় প্রতিবেদনটি৷
আর স্কুলে গেলেও তারা যে খুব ভালো মানের শিক্ষা পাচ্ছে তা নয়৷ জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন বলছে, দেশটির বিভিন্ন স্কুলে নিয়োজিত শিক্ষকদের শতকরা ৪৮ভাগই শিক্ষাদানে যথেষ্ট যোগ্য নন৷ সেই সাথে পর্যাপ্ত স্কুলের অভাব আর অবকাঠামোগত ঘাটতি তো আছেই৷ এসব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, উৎপাদনশীল খাতের জন্য যে দক্ষ জনবল প্রয়োজন সেই ঘাটতি তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর খুব দ্রুত যে পূরণ করতে পারবে তা নয়৷
এদিকে দেশটির অর্থনীতি বর্তমানে এক জরাজীর্ণ দশা পার করছে৷ চার কোটি মানুষের এ দেশটিতে মাথাপিছু দৈনিক আয় দুই ডলারের কম৷ বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশটির মাথাপিছু জিডিপি পাঁচশ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অনেক নিচে৷
আফগানিস্তানের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি ও কৃষি থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা৷ প্রতিবেশী পাকিস্তান, ভারত ও আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশ তাদের বড় বাণিজ্যিক সহযোগী। এ দেশগুলোতে আফগানিস্তান থেকে শুকনো ফল ও মসলাসহ নানা ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে৷
দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতির বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে৷ আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে অন্যের উপর নির্ভরশীল ও নড়বড়ে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক জানায়, আফগানিস্তানের জনবল দেশটির কম উৎপাদনশীল কৃষিখাতে নিয়োজিত৷
অর্থাৎ বলা যায় যে, গত কয়েক দশকেও কৃষিখাত ছাড়া নতুন তেমন কোনো উৎপাদনশীল খাত দাঁড়ায়নি যা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী রাখবে।
এদিকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও তুলনামূলক কম বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে৷ আর চলমান অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশটিতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে কতোটা আগ্রহী হবে সে বিষয়েও যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।
বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক টিলমান ব্র্যুক ডয়চে ভেলেকে জানান, আফগানিস্তানে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ খুব কম। তার মতে, বিদেশি সৈন্যদের উপস্থিতি না থাকার ফলে যে নিরাপত্তা ঘাটতি তৈরি হবে সে কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরো সীমিত হয়ে পড়বে।
এ বিশেষজ্ঞ অবশ্য তালেবানদের রাজনৈতিক আদর্শকেও অর্থনীতি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে একটি অন্তরায় মনে করেন । তার মতে, তালেবানদের রাজনৈতিক দর্শন বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় তারা আসলে অর্থনীতিতে গতি আনতে খুব একটা আগ্রহীও নয়।
এদিকে দেশটির অর্থনীতি অনেক বেশি মাত্রায় বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। আর তাই আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া তালেবানদের জন্য পরিস্থিতি মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযাযী, ২০১৬ সালে থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ১৫শ কোটি ডলারের অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়৷ হিসেব অনুযায়ী, সরকারি ব্যয়ের ৭৫ ভাগই বিদেশি সাহায্য থেকে মেটানো হয়৷
আর তাই সাহায্য নির্ভর এ অর্থনীতিকে ধরে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে কট্টরপন্থী এ গোষ্ঠীটির জন্য।
আয়ের কী কী উৎস আছে দেশটিতে?
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম থাকায় দেশটিতে কাঙ্খিত পরিমাণের শিল্পায়ন হয়নি৷ অর্থাৎ দেশে উৎপাদিত পণ্য বিদেশের বাজারে রপ্তানি করে নিজেদের অর্থনীতিকে চালানোর মতো অবস্থায় নেই দেশটি।
তবে পাহাড়বেষ্টিত এশিয়ার এ দেশটিতে ব্যাপক পরিমাণ খনিজ সম্পদ রয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে আয়রন, কপার, লিথিয়াম, কোবাল্টসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে৷ আর আফগান সরকারের এক প্রতিবেদনে দেশটির খনিজ সম্পদের পরিমাণ বলা হযেছে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার৷
ইলেকট্রিক গাড়ির উৎপাদন বাড়তে থাকায় বিশ্ব বাজারে লিথিয়ামের চাহিদা গত কয়েক বছরে শতকরা ২০ ভাগ করে বাড়ছে৷ আফগানিস্তানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম লিথিয়ামের উৎপাদনের কথা বলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। সে হিসেবে লিথিয়াম রপ্তানির মাধ্যমে আফগানিস্তান বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ তালেবানরা কতোটা কাজে লাগাতে পারবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এর কারণ হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজেদের গ্রহণযোগ্য উপস্থিতির অভাবকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তালেবান ও উগ্রপন্থী দলগুলোকে পর্যালোচনাকারী জাতিসংঘের সাবেক বিশষেজ্ঞ হানস-ইয়াকোব স্নাইডার ডয়চে ভেলেকে বলেন, আফগানিস্তানের বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থাভাজন ব্যবসায়িক সহযোগীর অভাবে এই মুহুর্তে তালেবানদের জন্য এসকল সম্পদের ব্যবহার অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে৷
স্নাইডার বলেন, আজকে যে খনিজ সম্পদগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেগুলো কিন্তু আগেও ছিল। যেমন তালেবানরা যখন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ক্ষমতায় ছিল তখনও এই সম্পদগুলো তাদের ছিল। কিন্তু তারা এগুলো উত্তোলন করতে পারেনি। তাই এ বিষয়ে তাদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
আর তাই কট্টরপন্থী এ দলটির অংশগ্রহণমূলক সরকার গঠনের কথা বলছে, জানান স্নাইডার। এটিকে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর একটি কৌশল হিসেবেই দেখছেন এ বিশেষজ্ঞ৷
এদিকে আফগানিস্তানে বিনিয়োগের বিষয়ে চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান এগিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে চীনের বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠান খনিজ সম্পদ উত্তোলনের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
তবে টিলমান ব্র্যুকের মতে, চীন দেশটিতে বিনিয়োগ করবে এমন সম্ভাবনা তৈরি হলেও পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানদের মতো একটি কট্টরপন্থী দলের সাথে সম্পর্ক রাখতে দ্বিধা বোধ করতে পারে।
মাদকভিত্তিক অর্থনীতি
জাতিসংঘের তথ্য মতে, বিশ্বে আফিম রপ্তানির শীর্ষে রয়েছে আফগানিস্তান। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে আফিমের ব্যাপক উৎপাদন হয়। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তকমা পাওয়া তালেবানরা গত বিশ বছর ধরে এ খাত থেকে নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যয় সামলাত। জাতিসংঘ বলছে, তালেবানরা মাদকের ব্যবসা থেকে বছরে ৩০ কোটি থেকে ১৬০ কোটি ডলার পর্যন্ত আয় করত। এর মধ্যে রয়েছে অবৈধভাবে মাদক চোরাচালান আর চাঁদাবাজি।
এদিকে কাবুল দখলের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তালেবান নেতারা জানান, তারা মাদক উৎপাদন বন্ধ করবেন। তবে মাদকের বিকল্প কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও চেয়েছে তারা।
এ প্রতিশ্রুতি আসলে কতোটা রাখবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। স্নাইডার বলেন, এ গোষ্ঠীটি গত বিশ বছর অবৈধ মাদক ব্যবসা আর চাঁদাবাজির উপর টিকে ছিল। আসলে তাদের আয়ের একমাত্র পথ এটি। আর তাই মাদক নির্মূলে তাদের যে প্রতিশ্রুতি সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
(এপি, এএফপি, রয়র্টাস, বিশ্ব ব্যাংক, ইউএসএইড)