1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তারুণ্য কেন কোটা বাতিলের আন্দোলনে?

শরিফুল হাসান
১২ জুলাই ২০২৪

তরুণরা রাজপথে, সরকার চাইছে আদালতে সমাধান, ছাত্রলীগ বলছে আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক রূপ' দেওয়ার চেষ্টা৷

https://p.dw.com/p/4iDmh
কোটাব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে আন্দোলন৷
কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক রূপ' দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে করে ছাত্রলীগ৷ছবি: Suvra Kanti Das/ABACAPRESS/IMAGO

বাংলাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন ‘বাংলা ব্লকেড' ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এর মধ্যেই ১০ জুলাই বাংলাদেশের উচ্চ আদালত কোটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছেন৷  আপিল বিভাগের এই আদেশের ফলে আপাতত কোটা থাকছে না বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল৷

আদালতের এমন আদেশের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের দিকে যাবে এমনটা ভাবা হলেও আন্দোলনকারীরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে৷ আর আদালত নয় সরকারকেই এই সমাধান দিতে হবে৷

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন–এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘আমরা মূলত সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছেই কোটা সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান চাইছি৷ এক দফা দাবি৷ এটি আদালতের এখতিয়ার নয়, এটি একমাত্র নির্বাহী বিভাগই পূরণ করতে পারবে৷ সরকারের কাছ থেকেই আমরা সুস্পষ্ট বক্তব্য আশা করছি৷''

এর আগে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা৷ এই আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সব ধরনের কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ তবে কোটা বাতিলের ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন৷ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন৷ চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ বছরের ৫ জুন রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট৷ এর মাধ্যমে ফের কোটা ফিরে আসার সুযোগ হয়৷

তবে হাইকোর্টের এই আদেশের পর থেকেই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে ফের আন্দোলনে নামেন৷ শুরুতে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবি সামনে রেখে আন্দোলন শুরু হলেও ৭ জুলাই থেকে আন্দোলনকারীরা সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করার এক দফা দাবি জানাচ্ছেন৷ দাবি আদায়ে সারাদেশে তারা বাংলা ব্লকেড নাম দিয়ে অবরোধ করছেন৷ কেবল ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়ক মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা৷

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীরা৷
কোটাব্যবস্থা সংস্কার আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো৷ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP

সরকার ভেবেছিল আদালতের স্থিতাবস্থার ওপর আন্দোলন প্রত্যাহার করবে শিক্ষার্থীরা৷১০ জুলাই আদালতের নির্দেশনার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আদালতের নির্দেশ মেনে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ারও আহ্বান জানান৷ তিনি বলেন, আদালত কোটা সংস্কার নিয়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন৷ আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত৷ আগামী আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে কোটা সংস্কার৷ কাজেই মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে, এমন কর্মসূচি বন্ধ করা দরকার৷

অন্যদিকে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক রূপ' দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে করে ছাত্রলীগ৷ তারাও গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে ক্লাস-পরীক্ষায় ফেরার আহ্বান জানিয়েছে৷

সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে কোথাও বাধা দেওয়া না হলেও পুলিশও গতকাল প্রয়োজনে কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছে৷ ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার খ মহিদ উদ্দিন গতকাল বৃহষ্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে আদেশ দিয়েছে, তারপর আর এ আন্দোলনের কোনো ‘যৌক্তিকতা নেই৷' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘রাস্তায় নেমে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷''

তবে শিক্ষার্থীরা সরকারি সব চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে তাদের বাংলা ব্লকেড অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে৷ এই আন্দোলনের আরেকজন সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, ‘‘আমাদের দাবি আদালতের কাছে নয়, সরাসরি নির্বাহী বিভাগের কাছে৷ আমাদের এক দফা দাবি শুধু রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ বা সরকারই পূরণ করতে পারে৷ সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সরকারি চাকরিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটাবৈষম্য আরও বেশি৷ কাজেই সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রেখে একটি পরিপত্র বা ডকুমেন্ট জারি করতে পারে৷''

অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের জন্য আদালতের দরজা সবসময় খোলা বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান৷ গতকাল বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগে একটি মামলার শুনানির সময় আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্টের নেতাদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘‘কোটা নিয়ে যারা আন্দোলন করছেন- তাদের পরামর্শ দিন, তারা কেন নির্বাহী বিভাগের কথা বলে? নির্বাহী বিভাগের যেকোনো সিদ্ধান্ত তো আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে৷ কোটা আন্দোলনকারীদের জন্য আদালতের দরজা সবসময় খোলা৷ তারা তাদের দাবিগুলো আইনজীবীদের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন, আমরা সেটি গুরুত্ব সহকারে শুনব৷''

সবমিলিয়ে খুব দ্রুত কোটা নিয়ে সমস্যা সমাধান হবে এমনটা আশা করা যাচ্ছে না৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো কোটা নিয়ে বারবার কেন তরুণরা আন্দোলন করছেন? কীভাবেই বা কোটা প্রথা এলো?

আসলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় সারা বিশ্বে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত৷ বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এই ব্যবস্থা শুরু হয়৷ তবে সেটা হয়েছিল নির্বাহী আদেশে৷

১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সরকারি একটা আদেশে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগে ২০ শতাংশ মেধা কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং ১০ শতাংশ নির্যাতিত নারী কোটা চালুর বিধান করা হয়৷ বাকি ৪০ শতাংশ রাখা হয়েছিল জেলা কোটা৷ ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়৷ ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়৷ বাকি ৫৫ শতাংশ কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়৷ পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ যোগ করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ৷ মানে হলো, প্রতি ১০০ পদে নিয়োগে ৫৬ জনকে নেওয়া হতো কোটা থেকে৷ ২০১৮ সাল পযর্ন্ত এভাবেই চলছিলো৷

ওই কোটা ব্যবস্থা অনুযায়ী, কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে পিএসসি যদি ১০০ জন লোক নিয়োগ করে, তাহলে মাত্র ৪৫ জন নিয়োগ পাবেন মেধার ভিত্তিতে, ৩০ জন নিয়োগ পাবেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মধ্য থেকে, ১০ জন নারী কোটায়, ১০ জন জেলা কোটায় এবং পাঁচজন নিয়োগ পাবেন উপজাতি কোটায়৷ এই ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে সবসময় মেধার চেয়ে কোটায় বেশি নিয়োগ হয়েছে৷ ফলে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে৷

সহজ করে বললে, প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়৷ কিন্তু অংশ নেন তিন থেকে চার লাখ পরীক্ষার্থী৷ কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি দুই লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি না-ও পেতে পারেন৷ কারণ, ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে৷ কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না৷ আবার কোটা থাকলে কেউ সাত হাজারতম হয়েও চাকরি পেতে পারেন৷

কোটা নিয়ে ক্ষোভের আরেকটি বড় কারণ ছিলো কোটার প্রার্থী না পাওয়া গে‌লে ওই পদগু‌লো শুণ্য রাখ‌তে হতো৷ আসলে বিএনপি-জোট সরকারের সময় বলা হতো, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না৷ তাই এই পদগুলো মেধা দিয়ে পূরণ করা হোক৷ আসলে অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তখন চাকরি পাননি৷ এ কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার কোটার পদগুলোতে প্রার্থী না পাওয়া গেলে সেগুলো শূন্য রাখার সিদ্ধান্ত নেয়৷ কিন্তু এবার দেখা যায় কোটার প্রার্থী না পাওয়ায় হাজার হাজার পদ শুন্য বিশেষ করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কৃষির মতো কারিগরি ক্যাডারে সবচেয়ে বেশি পদ ‍শূন্য ছিল৷

কোটা বাতিলের আগের বিভিন্ন বিসিএসের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮ থেকে ৩৮তম বিসিএসের (কোটা বাতিলের আগের শেষ বিসিএস) বিভিন্ন ক্যাডারে অন্তত ছয় হাজার পদ খালি ছিল৷ এমনকি, শুধু কোটার প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়া হলেও ওই বিসিএসেও মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৯৮টিসহ মোট এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়৷ একদিকে তরুণরা চাকরি পাচ্ছিলেন না অন্যদিকে কোটার কারণে পদ শূন্য বলে ক্ষোভ বাড়ছিলে৷

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার ওপর ২০০৮ সালের মার্চে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে কোটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছিলেন৷ ৬১ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে (তখনকার হিসাবে) নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়৷ সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে (যেমন সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য) কোটাকে অনুমোদন করেছে৷ ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনো সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না৷

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৭ সালে এক বৈঠকে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের প্রায় সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন৷ কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র এম এম জামান ছিলেন কোটার পক্ষে৷ তবে কোটার পক্ষে সেদিন জামানের অবস্থান থাকলেও তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবস্থাটি চালু রাখার পক্ষে ছিলেন৷ তবে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন তিনি, ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়৷ তবে ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি৷ বরং ২০১৮ সাল পযর্ন্ত ৫৬ শতাংশ কোটা ছিলো যা নিয়ে ক্ষোভ বেড়েছে তারুণ্যের৷

শুধু বিসিএস নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ অন্যান্য নিয়োগেও একই অবস্থা হয়৷ প্রার্থী না পাওয়ায় হাজারো পদ শূন্য ছিলো৷ একদিকে তরুণরা চাকুরি পাচ্ছেন না অন্যদিকে পদ শূন্য৷ এসব কারণেই কোটার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে৷ এর মধ্যে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৩৪ তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশের পর জানা যায় আগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে কোটার বন্টন হলেও ওই বিসিএসের প্রিলিমিনারিতেই কোটা বন্টন করা হয়৷ এর ফলে দেখা যায় মেধার জন্য এক রকম নম্বর আর কোটার জন্য অনেক কম নম্বর৷ বৈষম্যমূলক ওই ফলাফল বাতিলের দাবিতে তরুণরা রাজপথে নামে৷ কোটার বিরুদ্ধেও তারা আন্দোলন করে৷ পরে পিএসসি নতুন করে সংশোধিত ফলাফল প্রকাশ করে৷ তখন থেকেই কোটার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়েছে তারুণ্যের৷

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে তরুণরা৷ পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের দমন-পীড়নের মুখেও সারা দেশে এই আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে৷ এপ্রিলে মাসে ওই আন্দোলন সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে৷ তখন ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, ‘যখন কেউই কোটা চায় না, তখন কোন কোটাই থাকবে না, কোটা পদ্ধতি বাতিল৷'

প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার ৭৫ দিন পর কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা, সংস্কার বা বাতিলের সুপারিশ করার জন্য সচিব কমিটি গঠন করে সরকার৷ তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটির সদস্য ছিলেন অর্থ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব অপরূপ চৌধুরী, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব আক্তারি মমতাজ এবং লেজিসলেটিভ বিভাগের সিনিয়র সচিব শহিদুল হক৷

কমিটি সর্বসম্মতভাবে তিন দফা সুপারিশ করেছিল৷ প্রথমটি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মেধারভিত্তিতে নিয়োগ৷ দ্বিতীয়-বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল এবং তৃতীয়-কোটা বাতিলের ফলে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রতিফলিত প্রভাব নির্দিষ্ট সময় অন্তর পর্যালোচনা করা৷ কমিটি ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সরকার প্রধানের কাছে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে৷ প্রতিবেদন পাওয়ার পর ওই বছরের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷

তবে পুরোপুরি কোটা বাতিল হলো সেটিও একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল৷ কারণ, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা কখনো কোটাপদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল চাননি, তারা চেয়েছিলেন কোটার সংস্কার৷ আন্দোলনকারীরা তখন বলেছিলেন, কোটা ৫৬ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক৷ এমনকি তারা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নিতে রাজি ছিলেন৷ ওই সময়ে কোটা ২০ শতাংশ রাখা হলেও সমস্যা ছিলো না৷ তবে সরকার পুরোপুরি কোটা তুলে দেয় যেটি ছিলো অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত৷ এর ফলে ফের এ নিয়ে সংকটের সুযোগ সৃষ্টি হয়, হয়েছেও তাই৷

কোটাব্যবস্থার সংস্কারের আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা৷
বাংলাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন ‘বাংলা ব্লকেড' ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এর মধ্যেই ১০ জুলাই বাংলাদেশের উচ্চ আদালত কোটার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছে৷ছবি: Samir Kumar Dey/DW

কোটা বাতিলের পর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, নারী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়৷ ফলে সাতজন আদালতে গেলে আদালত জুন মাসে কোটার পক্ষে রুল দেন৷ ফলে এ বছর আবারো কোটা বাতিলের দাবিতে রাজপথে নামে তরুণেরা৷ জুলাই থেকে অবরোধ চললেও সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্কতা এবং ধৈর্য ধরে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়েছে৷ ফলে কোথাও কোন সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি৷ তবে রাজধানীসহ সারা দেশে জনদুর্ভোগ বেড়েছে৷ অথচ ২০১৮ সালেই যদি সবার জন্য ২০ শতাংশ কোটা রেখে সংস্কার করা হতো এই সমস্যা হতো না৷

কোটা বাতিলের পর ৪০তম, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসের দেখা যাচ্ছে, কোটাবিহীন নিয়োগে অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ বিশেষ করে কোটা বাতিলের পর বিসিএসে নারী, আদিবাসী ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার থেকে নিয়োগের হারও কমেছে, অথচ অনগ্রসরদের জন্য কোটা থাকতে পারতো৷

মনে রাখা দরকার, ১৯৭২ সালে কোটা পদ্ধতি চালুর নির্বাহী আদেশ দেওয়া হয়েছিল সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগে সেপ্টেম্বর মাসে৷আর সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ৪ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে৷ সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাতে সরকারি চাকরিতে ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব' লাভ করতে পারে, সে জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা যাবে৷  এই বিধান বলে নাগরিকদের ‘অনগ্রসর' অংশের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটার বিধান করলে অসাংবিধানিক হতো না৷ কিন্তু অনগ্রসর কারা বা এজন্য কী করতে হবে সেগুলো কখনো ঠিক করা হয়নি৷ ফলে বিতর্ক আর আন্দোলন চলছেই৷ কোটার কথা আসলেই সবাই ঘুরে ফিরে বেশি আলোচনা করেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত এই কোটা চলছে৷ স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকলেও ১৯৯৬ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য এবং পরে নাতি-নাতনিদের মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুযোগ দেওয়া হয়৷ এখন প্রশ্ন উঠছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সব সন্তান কিংবা নাতি-নাতনিরা কি সমাজের অনগ্রসর অংশ? আবার প্রশ্ন উঠে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের জন্য কোটা বেশি জরুরি নাকি শহীদের সন্তানদের জন্য? কারা অনগ্রসর৷ এদেশের তো কোন শহীদের সন্তান কিন্তু কোটা পায়নি৷

তরুণরা বলছেন, য‌ারা মু‌ক্তিযুদ্ধ ক‌রে‌ছেন তারা জা‌তির বীর সন্তান৷ তাদের নানাভাবে সম্মানিত করা যেতে পারে৷ পৃথিবীর বহু দেশে যুদ্ধ হয়েছে৷ কিন্তু যোদ্ধাদের বিশেষ করে তাদের সন্তান বা নাতি-নাতনিদের জন্য চাকরিতে কোটা দেওয়া আছে পৃথিবীর ২১০ টা দেশের কোথাও এমন নজির নেই৷ আর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি মানেই কী তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে? আচ্ছা মুক্তিযোদ্ধার কোন সন্তান বা নাতি যদি রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধীদের কাউকে বিয়ে করে তাহলে তো স্বাধীনতাবিরোধীরাও মুক্তিযোদ্ধা কোটা পাচ্ছে৷

আবার জেলা কোটায় কি সবাই সুবিধা পাচ্ছে? নারী কোটায় কী পিছিয়ে পড়া কোনো নারী সুবিধা পাচ্ছে, নাকি ঢাকা শহরের কোন নারী? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর খোঁজা হয়নি৷ ফলে কোটা নিয়ে দিনে দিনে ক্ষোভ বেড়েছে৷

অন্যদিকে কর্মকর্তা নিয়াগে ২০১৮ সালে কোটা বাতিল হলেও কর্মচারী নিয়োগে কোটা এখনো বহাল আছে৷ সরকারের প্রায় ৭৩ শতাংশ কর্মচারীর নিয়োগ হয় কোটায়৷ এরা সবাই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বা ১৩ থেকে ২০ গ্রেডে চাকরি করেন৷ সেখানে চাকরিই হয় ছয়টি কোটায়৷ এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী ১৫ শতাংশ, এতিম ও প্রতিবন্ধী কোটা ১০ শতাংশ, আনসার ও ভিডিপি ১০ শতাংশ এবং  ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ৷ এর মানে ১০০ ভাগের পুরোটাই কোটা৷

আবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০১৯ অনুযায়ী, সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদগুলোর ৬০ শতাংশ নারী প্রার্থীদের দিয়ে, ২০ শতাংশ পোষ্য (শিক্ষকদের সন্তান, বিধবা স্ত্রী বা বিপত্নীক স্বামী) প্রার্থীদের দিয়ে এবং ২০ শতাংশ পুরুষ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করতে হয়৷ এ নিয়েও বিভিন্ন সময় তরুণরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন৷

ফলে এবারের আন্দোলনে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটা বাতিলের দাবি উঠেছে৷ তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ন্যূনতম কোটাকে তারা সমর্থন করেন৷ তবে তারা ৫ শতাংশের বেশি কোটা চান না৷

আসলে প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, জাপান, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কোটা আছে৷ আর যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদেও স্পষ্টভাবেই অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য বিশেষ বিধানের নীতি আছে৷ কাজেই অনগ্রসরদের জন্য কোটা রাখা যেতেই পারে৷ এক্ষেত্রে কারা অনগ্রসর নাগরিক সেটি চিহ্নিত করা জরুরি৷  প্রতি পাঁচ বছর পর পর এগুলো ঠিক করা যেতে পারে৷ তবে যাই হোক কোটার চেয়ে মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে ন্যায্যতা ও সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে সংস্কার করা জরুরি৷

এক্ষেত্রে আদালত কোন সমস্যা নয়৷ কারণ বৃহস্পতিবার বিকেলে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ যে রায় প্রকাশ করেছেন তাতে কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে৷ওই রায়ে ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে কোটা রাখার কথা বলা হয়েছে৷ তবে সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে৷ তার মানে এখানে কতো শতাংশ কোটা থাকবে সেটা সরকারেই নির্ধারণ করতে পারবে৷ আবার কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার কথাও বলেছে সরকার৷ আদালতের এই রায় মেনে সরকার এখন দ্রুতই কোটার সমস্যা সমাধান করতে পারবে৷ এক্ষেত্রে মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে ন্যায্যতা ও সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে সংস্কার করলে সবার মঙ্গল৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান