1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই লড়ছেন চিকিৎসকরা

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
১৭ এপ্রিল ২০২০

চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরাই এ বার করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। কারণ, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে অতি প্রয়োজনীয় অস্ত্রই তারা পাচ্ছেন না।

https://p.dw.com/p/3b3oa
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/S. Pan

ভারতে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ঠিক কোন জায়গায় আছে, করোনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। বলা যেতে পারে, যবে থেকে করোনার প্রকোপ শুরু হয়েছে, তবে থেকে প্রতিদিনই এই করুণ অবস্থাটা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মাস্ক নেই, স্য়ানিটাইজার নেই, স্পিরিট নেই, পিপিই বা চিকিৎসকদের সুরক্ষা-পোশাক নেই, করোনা পরীক্ষার কিট নেই, নার্স ও হাসপাতালের কর্মীদের জন্য উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই., ভেন্টিলেটার নেই, স্যানিটাউজার নেই, চিকিৎসক ও চিকিৎসা-কর্মীদের নিয়মিত করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, এককথায় পুরোপুরি নেই-রাজ্যের ছবি। এর মধ্যে আছে কেবল সরকারি চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার অদম্য জেদ, তাঁদের সেবাভাব, নিরন্তর খেটে যাওয়ার ক্ষমতা এবং উদ্বাবনের দক্ষতা। উত্তর ভারতে 'জুগাড়' বলে একটা কথা খুব চালু আছে, বাংলায় অনুবাদ করলে বলতে হয়, 'কোনওভাবে জোগাড় করে নেওয়া'। কোনও সমস্যা হলে কোনও না কোনও ব্যবস্থা উদ্ভাবন করে লড়াইটাকে জারি রাখা বা সমস্যার সমাধানে পৌঁছনো।

কিন্তু এই ভাবে 'জুগাড়' দিয়ে তো করোনার বিরুদ্ধে নিত্যদিন লড়া যায় না। চিকিৎসক ও বিশেষ করে চিকিৎসা কর্মীদের কাছে ন্যূনতম সুরক্ষা সামগ্রী তো দিতে হবে, না হলে তাঁরা কাজ করবেন কী করে? আর বাস্তব অবস্থাটা কী? বৃহস্পতিবার দিল্লির দুটি খুব বড় বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলেন চিকিৎসক পার্থ প্রতিম বোস। সেখানে হাত ধোওয়ার স্পিরিট নেই, মাস্ক নেই। এই সব হাসপাতালে বিদেশ থেকে পর্যন্ত রোগীরা চিকিৎসা করতে আসেন। সেখানে যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে ছোট শহর বা গ্রামগঞ্জের হাসপাতালের অবস্থা কী তা সহজেই বোঝা যায়।

চীনে করোনার তাণ্ডব শুরু হওয়ার কয়েক মাস পরে ভারতে তার প্রকোপ শুরু হয়েছে। ফলে প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় পাওয়া গিয়েছিল। তখন প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিলো কি? হলে তো এত অপ্রস্তুত, এতটা সহায় সম্বলহীন অবস্থায় থাকতে হতো না। এই রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে চিকিৎসকদের যে সুরক্ষা পোশাক পরা দরকার, তার নাম পিপিই। সেই পোশাক আবার প্রতি ছয় ঘন্টায় একবার করে জীবাণুশূন্য করা দরকার। ভারতে সরকারি চিকিৎসকদের হাতে পিপিই তুলে দেওয়াই যাচ্ছে না। পিপিই দূরস্থান, মাস্ক, স্যানিটাইজার নেই। গুয়াহাটি আইআইটি সেখানকার হাসপাতালের জন্য স্যানিটাইজার, মাস্ক বানাচ্ছে। তাও দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ডাক্তার, নার্সদের কাছে যদি স্পিরিট, মাস্কের মতো জিনিস না থাকে, তা হলে তাঁরা কী দিয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করবেন?

তার ফলটাও হাতে নাতে পাওয়া যাচ্ছে। সমানে চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয়রা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এমনিতেই ভারতে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ২০ লাখ নার্স কম। ২০১৯ এর হিসাব, দেশে অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসকের সংখ্যা ১১ লাখ ৫৭ হাজার। তার মধ্যে সক্রিয় চিকিৎসক হলেন নয় লাখ ২৬ হাজার। প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কম। এই চিকিৎসকেরা তো সকেলই সরকারি হাসপাতালে কাজ করেন না। তাই চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের করোনা হতে থাকলে সংকট আরও বাড়বে। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি হাসপাতালের নার্সের কথায়, ''আমাদের লাগাতার তিন থেকে সাতদিন কাজ করে যেতে হচ্ছে। তারপর এক বা দুই দিনের বিশ্রাম পাচ্ছি। তখন ঘরে যেতে ভয় লাগছে। আমাদের যদি করোনা হয় তো পরিবারের লোকেদেরও হয়ে যাবে। আমাদের তো সেই পয়সা নেই যে, হোটেল বুক করে থাকব''। তার ওপর ভাড়া বাড়ি হলে বাড়িওয়ালারা বিনা নোটিশে ঘর ছেড়ে দিতে বলছেন অনেক জায়গায়।

দিনের পর দিন কি এইভাবে বিনা সুরক্ষায় খেটে যাওয়া সম্ভব? দিল্লিতে সদ্য চাকরি পাওয়া এক চিকিৎসককে দিনে ১৭ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করতে হচ্ছে। বাড়িতে ফিরে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টার মধ্যে আবার চলে যেতে হচ্ছে হাসপাতালে। নিঃসন্দেহে এই অস্বাভাবিক সময়ে তা করতে হবে। কিন্তু তার জন্য তো পরিকাঠামোগত সাহায্য দরকার।  চিকিৎসক সমরজিৎ জানার মতে, ''আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা যে কোন মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে, করোনার বাজারে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। পিপিই তো শুৎু করোনা আটকাতে লাগে না, এটা চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য একেবারে আবশ্যিক জিনিস। মহামারির ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। করোনা দেখাল, ভারতে তা নেই। এখন খুব খারাপ মানের পিপিই তৈরি করা হচ্ছে। চিকিৎসকরা মানুষের সেবা করার জন্য এসেছেন। কিন্তু তাঁদের সুরক্ষা না দিলে তাঁদের মাধ্যমে লোকের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে যাবে। তাঁরা কোন ভরসায় দিনের পর দিন কাজ করে পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন?'' তাই এখন অনেকে কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন। অনেকে ছুটি নিতে চাইছেন।

দিল্লি, উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যে কয়েকটি হোটেল ভাড়া করে চিকিৎসকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় আর কতটুকু? বাকিদের ঘরে ফিরতে হচ্ছে। নার্স বা বাকি চিকিৎসা কর্মীদের জন্য তো সেই ব্যবস্থাও নেই।  পার্থ প্রতিম বোস মনে করেন, ''চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা তো করতেই হবে, তার ওপর তাঁদের নিয়মিত করোনার পরীক্ষা করতে হবে। সেটাও হচ্ছে না। তাঁদের সুস্থ রাখতে হবে। তা হলে ই তো তাঁরা অন্যদের সুস্থ করবেন। না হলে এই লড়াই তাঁরা কী করে লড়বেন?''

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

তাই চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য একদিন পরম উৎসাহে হাততালি দিয়ে বা থালা বাজিয়ে কোনও লাভ নেই, তাঁরা এমনিতেই প্রাণ দিয়ে লড়ছেন। তাঁদের কাছে ন্যূনতম সুরক্ষার জিনিস পৌঁছে দিতে হবে। পারলে তাঁদের আলাদা হোটেলে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আর তাঁদের প্রতি খারাপ ব্যবহার করা থামাতে হবে। দিল্লিতেই একটি হাসপাতালে করোনা রোগীরা চিকিৎসক ও কর্মীদের মারধর করেছেন। দেশের বহু এলাকায় তাঁরা করোনা পরীক্ষা করতে গিয়ে লোকের আক্রমণের মুখে পড়েছেন। এইমসের চিকিৎসকদের সংগঠন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি দিয়ে বলেছে, এরপর থেকে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা করোনা পরীক্ষা করতে গেলে, তাঁদের সঙ্গে সশস্ত্র কেন্দ্রীয় পুলিশ দিতে হবে।

তাই হাততালির দরকার  নেই, থালা বাজানোর দরকার নেই, তাঁদের কাজ করার পরিকাঠামো দিলেই হবে। তাঁদের কাজে বাধা না দিলেই চলবে। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার হয়ে করোনার মোকাবিলা  না হলে কী ভাবে চালিয়ে যাবেন তাঁরা?

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷