ডিজিটালাইজেশন সবকিছুকে হাতের নাগালে আনে, দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই সহজে, স্বয়ংক্রিয় উপায়ে করা যায়৷ সেবা পেতে অফিসে যাওয়া এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা লাগে না৷ মানে হলো, আপনি যেখানে আছেন, সেখানে বসেই আপনার চাহিদা মেটাতে বা কাজটি সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে পারেন৷ ফলে, আপনার সময় বাঁচাবে, আবার অর্থের অপচয়ও হবে না৷
কিন্তু আমরা কি সর্বত্র সেটা করতে পারছি? উত্তর হচ্ছে- না৷ দেড় দশকে মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক প্রসারের ফলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে৷ প্রযুক্তির প্রসারের ফলে অনেক নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে৷ মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের কারণে লেনদেন সহজ হয়েছে৷ আপনি ঘরে বসে খাবার অর্ডার করেও খেতে পারছেন৷ আপনাকে ব্যাংকে বা ক্যাফেতে যেতে হচ্ছে না৷ এটা হচ্ছে ডিজিটালাইজেশনের আশীর্বাদ৷
তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে৷ যেমন, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র- এই দুটি খাতে হাজার কোটি টাকা খরচ করে সেখানে ডিজিটালাইজেশন করা হলেও সেবা ডিজিটাল হয়নি৷ ধরুন, আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রে কোনো সমস্যার সমাধান করতে চান, তাহলে আপনি কী করবেন? ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে তা করবেন৷ কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না৷ তাই আপনাকে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে, বিড়ম্বনা সহ্য করে সেবাটি নিতে হবে৷
আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক৷ ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সড়কে টোল আদায়ের কাজটি স্বয়ংক্রিয় করা, যাতে যানবাহনকে থামতে না হয়৷ ২০২২ সালের শেষে এসে দেখা গেল, একটি সড়কেও সেটা করা সম্ভব হয়নি৷ আবার ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি কমানো, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি কম৷ অন্যদিকে ডিজিটালের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের বৈষম্য বেশ প্রকট৷ করোনাকালে শহরের শিশুরা ঠিকই অনলাইনে ক্লাস করেছে, কিন্তু গ্রামের শিশুরা বঞ্চিত হয়েছে৷
২০২১ সালের মধ্যে সব সরকারি সেবা যেকোনো স্থান থেকে সহজে, স্বচ্ছভাবে, কম খরচে ও কম সময়ে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পাওয়া যাবে৷ কিন্তু সেবা কম্পিউটারভিত্তিক হয়েছে, ডিজিটাল হয়নি৷ যেমন, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে মানুষকে কয়েকবার বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়৷ আর এনআইডি থাকা সত্ত্বেও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে নতুন করে আঙুলের ছাপ দিতে হয়৷
এমন উদাহরণের শেষ নেই৷
অবশ্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদসহ সরকারের অনেকেই দাবি করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জনে সরকার শতভাগ সফল৷ সরকারি সেবাগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে৷ তারা হয়ত অনলাইনে একটি ফর্ম পূরণকেই ডিজিটালাইশন মনে করেন!
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের সব অফিস ও দফতর ‘ডিজিটাল’ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে৷ ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে এক ‘অশুভ’ প্রতিযোগিতায় নামে সবাই৷ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গ্রহণ করে প্রকল্প ও কর্মসূচি৷ টাকা খরচের প্রতিযোগিতায় নামে মন্ত্রণালয় ও দফতরসমূহ৷ প্রযুক্তি ব্যবহারের নামে অর্থ কিভাবে অপচয় করতে হয় তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ই-গেট ইমিগ্রেশন৷ গত বছর উদ্বোধনের পরই সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়য়৷ কারণ, ম্যানুয়েল পদ্ধতির চেয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাসপোর্ট ও ভিসা পরীক্ষা আরো সময়সাপেক্ষ৷ ফলে উদ্যোগটি অর্থহীন হয়ে পড়ে৷
আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, যশোরে নির্মিত শত কোটি টাকার শেখ হাসিনা সফটওয়্যার পার্ক৷ এখন তা পরিণত হয়েছে রিসোর্ট ও কমিউনিটি সেন্টারে৷
একটি দেশ ডিজিটাল হলে সেই দেশ ও তার নাগরিকের সকল ধরনের ডাটা ও তথ্য পদ্ধতিগতভাবে তৈরি করার কথা৷ অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, বাজেট বরাদ্দ, আয়-ব্যয়ের হিসাব সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করা হয়৷ এটা ডিজিটালাইজেশনের প্রাথমিক ধাপ৷ অথচ আমরা এটা করতে ব্যর্থ হয়েছি৷
এর অন্যতম কারণ হলো এলোমেলো ডিজিটালাইজেশন৷ অনেক প্রকল্প বা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে দেশবাসীকে দেখানো ও রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য, সেগুলো মানুষের কাজে আসুক বা না আসুক৷ মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোর বেশি মনোযোগ ছিল হার্ডওয়্যার ক্রয়ের দিকে, দৃশ্যমান কিছু করে দেখানোতে৷ আবার এক মন্ত্রণালয় কী করছে তার সাথে অন্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ছিল না৷ এছাড়াও মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদেরও এ বিষয়ে ছিল না পরিষ্কার ধারণা৷
এমন অপরিকল্পিত, বিচ্ছিন্ন ও নিয়ন্ত্রণহীন ডিজিটালাইজেশন অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগও সৃষ্টি করে৷ যে যেভাবে পেরেছে উদ্যোগ নিয়েছে, অর্থ খরচ করেছে৷ এর অনেক কিছু ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিল না কোনো জবাদিহিতা৷
এমন এক অবস্থায় স্মার্ট বাংলাদেশে নতুন একটি রূপকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে৷ আবারও নেয়া হবে অনেক প্রকল্প ও কর্মসূচি, বিদেশ থেকে কেনা হবে প্রচুর হার্ডওয়্যার৷ কিন্তু সঠিক পরকিল্পনা, সমন্বয় স্বচ্ছতা আর জবাদিহিতা না থাকলে নতুন এই রূপকল্প ঠিকমতো বাস্তবায়িত হবে না, হবে অনেক অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি৷