ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘অপব্যবহার' চলছেই
৩১ মার্চ ২০২৩ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটকের পর র্যাব হেফাজতে একজন নারীর মৃত্যু এবং প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে আটকের পর ওই আইনে মামলা দেয়ায় আইনটি নিয়ে আবার ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকরা এই আইনটি বাতিলের দাবি করেছেন, সাংবাদিক নেতারা বলছেন আইনটির সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ধারা সংশোধন করা অতি জরুরি। বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, আইনটির ‘অপব্যবহার' করার জন্যই এখনো টিকিয়ে রাখা হয়েছে, কারণ, এই আইনটি দিয়ে সহজেই যে কাউকে হয়রানি করা যায়।
নওগাঁয়ে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনকে আটকের পর তার বিরুদ্ধে জিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। আর তিনি র্যাব হেফাজতে থাকা অবস্থায়ই মারা যান। মামলা হয় পুলিশের কাছে। কিন্তু তার আগেই তাকে র্যাব আটক করে।
হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের কারণে ওই ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১১ র্যব সদস্যকে প্রত্যাহার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আর মামলাটি করেছেন যুগ্ম সচিব এনামুল হক।
এদিকেপ্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে সাভার থেকেসিআইডি পরিচয়ে তুলে নেয়ার ১৮ ঘণ্টা পর রমনা থানায় দায়ের করা ডিজিটাল নিরপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আদালতে নেয়া হয় ৩৫ ঘণ্টা পর। তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ওই একই মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে,
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, " এই সময়ের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, জোরপূর্বক অপহরণ ও নিখোঁজ, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।”
আর বাক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিনের হিসাবে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সারা দেশে ২২৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১০টি মামলা হয়েছে। এইসব মামলায় মোট ৫৪ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে সব মিলিয়ে ৫৭৩টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪০৪ জনকে। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়।
২০১৮ সালের অক্টোবরে এই আইনটি কার্যকর হওয়ার আগে থেকেই আইনের খসড়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তখন আইনের সুনির্দিষ্ট আটটি ধারা নিয়ে কথা বলে তা সংশোধনের জন্য লিখিত প্রস্তাব করা হয়। নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার কর্মীরাও আইনটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরে বাতিলেরও দাবি করেন। আইনটি কার্যকর হওয়ার পরও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংশোধনের কথা বলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, "এই আইনের কোনো অপপ্রয়োগ হবে না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হলেও তদন্ত না করে তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না। আর সাংবাদিকরা অন্যায়ভাবে এই আইনের শিকার হলে আমি নিজে আইনি সহায়তা দেবো।”
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, " আইনমন্ত্রী তার কথা রাখেননি। তিনি কথা রাখলে আমরা তাকে ধন্যবাদ দিতে পারতাম। সাংবাদিকরা চোর-ডাকাত নয় যে তাদের মামলা করে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তবে সাংবাদিকরা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে। তাদের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে, তাতে আমরা লজ্জা পাই। আমরা মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী যে কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, প্রশাসনের লোকজন সে অনুযায়ী কাজ করছেন না।”
তবে তিনি বলেন, " সাম্প্রতিক যে ঘটনা ঘটেছে (প্রথম আলোর সাংবাদিক গ্রেপ্তার), সেখানে এক ধরনের অপসাংবাদিকতা আমরা দেখেছি। স্বাধীনতা দিবসে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই ধরনের অপসাংবাদিকতাও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।”
আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান ফারুক ফয়সল মনে করেন, "সরকার একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে এই আইনটি ব্যবহার করছে। সরকারের আত্মবিশ্বাস যখন কমে যায়, তখন সরকার এই কাজ করে।”
তার কথা, "এই আইনটির অপব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। শুধু সাংবাদিক নয়, বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ এর শিকার হচ্ছেন। আইনমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, নওগাঁর যে নারী হেফাজতে মারা গেলেন, তাকে মামলার আগেই আটক করা হয়। যে মারা যাওয়ার পর ডিজিটাল আইনে মামলা হয়। আইনমন্ত্রীর এই কথায়ই বোঝা যায় নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, "এই আইনটি নানাভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। মামলা না করে আটক পরে মামলা দেয়া হচ্ছে। মধ্যরাতে মামলা করে আটক করা হচ্ছে। এই আইনে মানুষকে হয়রানি করার সব উপদান আছে। আমরা এই আইনটি বাতিলের দাবি করছি।”
তার কথা, "সরকার আইনটি বাতিল করছেনা এর কারণ হলো, সরকার কোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করতে পারেনা। গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা আরো সংকুচিত করতে চায়।”
আর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, "সাংবাদিকরা , মানবাধিকার কর্মীরা এই আইনটি বাতিলের জন্য বহুবার বলেছেন। হাইকোর্ট আইনটি কেন বাতিল হবে না তার জন্য রুলও দিয়েছে। তারপরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। উন্নতি এরকম হয়েছে যে, আগে মামলা করার পর গ্রেপ্তার করা হতো এখন মামলার আগেই গ্রেপ্তার করা হয়।”
তার কথা, "এই আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ভয়ের মধ্যে রাখতে চায় সরকার। আর সাংবাদিকদের একাংশও সরকারকে এই আইনের ব্যাপারে সমর্থন দিচ্ছে। সরকার তার সুবিধা নিচ্ছে।”
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, " ডিজিটাল আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আপনারা যদি সত্য প্রকাশ করেন, তাহলে কোনোভাবেই এই সরকার বাধা দেবে না।”