‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অসাংবিধানিক’
১ জানুয়ারি ২০২২গত বুধবার ক্রাইম রিপোর্টারদের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ইনকোয়ারি অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে৷ এখন এই আইনে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় না৷ আগে যাচাই-বাছাই করা হয়৷ এই আইন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য করা হয়নি৷’’
পরের দিন সাংবাদিকদের আরেকটি অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আইনটির অপব্যবহারের কথাও স্বীকার করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷’’
তবে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে অসাংবিধানিক বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা৷ তারা বলছেন, একই আইনে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে, কাউকে হবে না ফৌজদারি আইনে এটা হতে পারে না৷
সংবিধান বিশেষজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা শ্রেণির জন্য একরকম হবে, আর অন্যদের বেলায় প্রয়োগ অন্যরকম হবে এই ধরনের উদ্ভট কথা গত ৫০ বছরে কেউ বলেছে বলে শুনি নাই৷ আমি আইন জানি এ কারণে আমি চুরি করলে আমাকে গ্রেপ্তার করবে না, আর আপনি আইন জানেন না এই কারণে আপনি চুরি করলে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে, এই কথা কী আইন বলতে পারে? শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি ছাড়া ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হবে৷ আইনমন্ত্রী যেটা বলেছেন, এটা অসাংবিধানিক এবং উদ্ভট কথা৷ আবার আইনমন্ত্রী বলেছেন, কেউ গ্রেপ্তার হলে তার জামিনের ব্যবস্থা করা হবে৷ আমি তো জানি জামিন দেয় কোর্ট, আইনমন্ত্রী না৷ বাস্তবিক অর্থে কি হয় সেটা অন্য কথা৷ একটা গোষ্ঠীর জন্য আইনের প্রয়োগ একরকম হবে, অন্যদের ক্ষেত্রে অন্যরকম হবে, সেটা রাজা-বাদশাহদের আমলে হতো৷’’
একই কথা বলছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি)৷আইনের চোখে সবাই সমান এ নীতির কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে শুধু সাংবাদিক নয়, দেশের সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার না করার দাবি জানিয়েছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান৷
এদিকে আইনমন্ত্রী ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সংশোধনের কথা বললেও কী ধরনের সংশোধন হবে তা স্পষ্ট করে বলেননি৷
আইনটি সংশোধনের জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সংসদীয় কমিটিতে এটা আসেনি৷ এখন পর্যন্ত কমিটিতে এটা নিয়েও কোনো ধরনের আলোচনা হয়নি৷ অন্য কোনো সংসদীয় কমিটিতে গেছে কি না জানি না৷ আমাদের এখানে যদি আসে তাহলে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব৷''
এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক ধারাগুলোর সংশোধনীর বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দেওয়া বক্তব্যকে সাধুবাদ জানিয়েছে টিআইবি৷
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের শুরু থেকেই এটির বেশ কিছু ধারা বিশেষ করে ২৫ ও ৩১ নিয়ে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিলো৷ মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এটি খড়গহস্ত হওয়ার শঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছিলো৷ কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি৷ আইনটির অপব্যবহার রোধে যেকোনো ধরনের সংশোধনে গঠিত কমিটিতে সব অংশীজন, বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা জরুরি৷ শুধু রাজনীতিবিদ আর আমলারা এটা করলে হবে না৷ নয়তো নতুন উদ্যোগটিও ভেস্তে যাবার শঙ্কা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷’’
আইনজীবী শাহদীন মালিকও বলেছেন, ‘‘হ্যাকিংয়ের বিষয়টি আইনে থাকতে পারে৷ এটা অন্য কোনো আইনে নেই৷ কিন্তু বাক স্বাধীনতার অংশটুকু পুরোটাই বাদ দিতে হবে৷ আমাদের সাইবার সিকিউরিটির জন্য একটা আইন প্রয়োজন, কিন্তু সেটা এটা না৷ এই আইনটি যেভাবে লেখা হয়েছে, সেটা কোনোভাবে সংশোধন করে এর অপপ্রয়োগ রোধ করা যাবে না৷’’
শুক্রবার এক বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার ও দুর্ব্যবহার হয়েছে বলে স্বীকার করে, বিশ্বের সেরা চর্চাগুলোর অনুসরণ করে আইনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতে সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন আইনমন্ত্রী৷ ভিন্নমত, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করে আইনের এমন ধারাগুলো পর্যালোচনা করে সংশোধন করার ব্যাপারে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে অবশেষে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হিসেবে উল্লেখ করেছে টিআইবি৷
প্রসঙ্গত, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা ছিল কমপক্ষে ১ হাজার ১৩৪টি৷ এর মধ্যে বিভিন্ন থানায় ৮৮৩টি এবং সরাসরি আদালতে ২৫১টি মামলা হয়েছে৷
আর যুক্তরাজ্যের বেসরকারি সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিনের তথ্য বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা ২০২১ সালের এগারো মাসে মামলা হয়েছে ২২৫টি, যেখানে ৪০০ জনের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে৷ এরমধ্যে ১৬৬ জনকেই আটক বা গ্রেফতার করা হয়েছে৷ আবার এসব মামলার বড় অংশই হয়েছে ক্ষমতাসীনদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তির জন্য৷
এ আইনের করা মামলায় কারাগারে থাকা লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়েছে৷