ডাক্তারিতে আজকাল ব্যবসা বেশি সেবা কম
৫ মার্চ ২০১৭প্রচলিত বিশ্বাস ডাক্তারি পেশার মতো মহত পেশা আর হয় না৷ অথচ ক্রমশ সেই পেশাতেই কালির ছিঁটে পড়ছে৷ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বেসরকারি ও কর্পোরেট চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই নিয়ে হৈ চৈ কম হচ্ছে না৷ ব্যবসায়িক মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে অনৈতিক মেডিক্যাল পদ্ধতির প্রয়োগ চলছে আকছার৷ সম্প্রতি ভারতের কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে গ্রামে স্ত্রীরোগে আক্রান্ত হতদরিদ্র মহিলাদের যথেষ্ট মেডিক্যাল যৌক্তিকতা ছাড়াই তড়িঘড়ি অপারেশন করে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে৷ রাজ্য সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির তদন্ত রিপোর্টে এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা উঠে এসেছে৷
গত দু-এক বছরে অন্তত ২২৫৮টি হিস্টারেক্টমি অপারেশন করা হয়েছে যথেষ্ট মেডিক্যাল কারণ এবং মেডিক্যাল অনুশাসনবিধি ছাড়াই৷ রাজ্য সরকারের বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট জেলার ডেপুটি কমিশনার উজ্জ্বল ঘোষ অভিযুক্ত হাসপাতালগুলির লাইসেন্স বাতিল করার আদেশ দেন৷ কর্নাটক মেডিক্যাল কাউন্সিলকে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যেন পেশাগত নৈতিকতা চিকিতত্সা অনুশাসনবিধি লঙ্ঘন এবং অসাধু উপায় অবলম্বনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ কারণ এর খেসারত দিতে হচ্ছে কর্নাটকের গ্রামাঞ্চলের অনেক অল্পবয়সি নারীদের৷ তাঁদের জীবনে অকালে নেমে এসেছে অন্ধকার৷
স্ত্রীরোগের উপসর্গ নিয়ে গ্রামের গরিব পরিবারের বৌ-ঝিরা হাসপাতালে যান ডাক্তার দেখাতে৷ যেমন পিঙ্কু বাই৷ তাঁর বিয়ে হয়েছিল ১৩ বছর বয়সে৷ ১৯ বছরের মধ্যেই তিনটি সন্তানের জননী৷ ২৪ বছরে তলপেটে যন্ত্রণা, যোনিপথে তরল স্রাব নিসরণের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে যান ডাক্তার দেখাতে৷ ডাক্তাররা বলেন, তার দেহে স্বাস্থ্য জটিলতা রয়েছে৷ জরায়ু ফুলে গেছে৷ অবিলম্বে হিস্টারেক্টমি অপারেশন করে জরায়ু কেটে বাদ না দিলে জীবনসংশয় হতে পারে৷ জীবনের ভয় দেখাতে পিঙ্কু বাইয়ের দুশ্চিন্তা – মরে গেলে কে তাঁর বাচ্চাগুলোকে দেখবে? অতি গরিব পরিবার৷ তাই ধারদেনা করে অপারেশনের খরচ বাবদ ৩০ হাজার টাকা হাসপাতালের বিল দিতে হয়৷ তবু সে পুরোপরি সুস্থ হয়ে উঠেনি৷ কোমরে ব্যথা, ক্লান্তি, দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, বুকে ব্যথা৷ দৃষ্টিশক্তি কমজোরি হওয়ায় সে কাহিল৷ কর্নাটকের লাম্বানি জনজাতির নারীদেরও একই দশা৷ একদিকে নিরক্ষতা, দারিদ্র৷ অন্যদিকে চিকিত্সকদের অর্থ লালসায় পেশাগত নৈতিকতার শ্বাসরুদ্ধ৷ নির্দিষ্ট চিকিত্সাবিধির পরোয়া না করে দ্রুত বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধি৷ কোনো কোনো রোগিণীর ক্ষেত্রে মূত্রনালিতে সংক্রমণ হলেও, তার নিদান হিসেবে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়৷ বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষা, টেস্ট না করেই৷ একই দিনে চারজনের হিস্টারেক্টমি অপারেশন করে গর্ভাশয় কেটে বাদ দেওয়া হয়৷ এদের মধ্যে একজন মারা যায়৷
কর্নাটকের কেআইসি নামে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এক এনজিও অভিযুক্ত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয়৷ দোষি ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করার দাবি জানায়৷ এই এজিও-র সদস্যা টিনা জেভিয়ার মনে করেন, মহিলাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ডাক্তারের কাছে টাকা রোজগার করাই প্রধান৷ ইদানীং কর্নাটকের সংলগ্ন মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদ জেলাও হিস্টারেক্টমি অপারেশনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে৷ আশপাশের গাঁ-গঞ্জ থেকে রোগিণীদের ভিড় বাড়ছে৷
কেন বাড়ছে? এর প্রধান কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সমাজসেবী রূপা হাসান৷ তিনি বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশই মুখ্যত এরজন্য দায়ী৷ ঐ সব গ্রামের প্রচলিত রীতিনীতি, আচার-বিচার, সংস্কার একেবারে আদ্যিকালের৷ যেমন মেয়েদের মাসিক বা ঋতুস্রাবকালে থাকতে হয় ঘরের বাইরে, দূরে একটা নোংরা গুমটি ঘরে বা গোয়ালঘরে৷ এতে করে যোনিপথে সংক্রমণ হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ প্রতিমাসের এই জ্বালা-যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতে অনেকেই জরায়ু কেটে বাদ দেওয়াকে বেশি স্বস্তিকর বলে মনে করে৷ মাথা না থাকলে মাথা ব্যাথাও থাকবে না, ব্যাপারটা এমনই৷ কিছু চিকিত্সক নারীদের যৌনজীবন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করেই তড়িঘড়ি হিস্টারেক্টমি অপারেশন করে জরাযু বাদ দিয়ে দেন৷
এই কথারই প্রতিধ্বনি করে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আর. ভেঙ্কটেশ বলেন, অত্যধিক রক্তস্রাব, সংক্রমণ, ফাইব্রয়েড নিয়ন্ত্রণে অন্যসব চিকিত্সায় কাজ না হলে হিস্টারেক্টমি অপারেশন করা হয়ে থাকে, তাও একেবারে শেষ পর্যায়ে৷ তবে সেটাও করতে হবে বায়োপসি, প্যাপ স্মিয়ার ইত্যাদি পরীক্ষার পর৷ সমাজকর্মী কে. নীলার নেতৃত্বে কর্নাটক রাজ্য মহিলা কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট বলছে, যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ এবং নথিপত্র দাখিল করা হয়৷ কিন্তু অভিযুক্ত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আজও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ তবে একটি তদন্ত রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে৷ সরকারি হাসপাতালের জনৈক বড় ডাক্তার বেসরকারি হাসপাতালে গত দু'বছর ধরে অনাবশ্যকভাবে প্রায় ১৪০০টি হিস্টারেক্টমি অপারেশন করেছেন, সেইসব মহিলাদের ওপর, যাদের ৪০ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নীচে৷ শাস্তি হিসেবে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয় মাত্র৷
কিছু ডাক্তারের অনৈতিকভাবে চিকিৎসা শাস্ত্রের অনুশাসন লঙ্ঘন করার ফলে গোটা চিকিৎসক সমাজের যে বদনাম হচ্ছে, তাতে তাঁদের প্রতি মানুষের বিশ্বাসবোধ নড়ে যেতে তো পারেই৷