টেলিভিশন থেকে তথ্য চুরি
৩ জুন ২০১৬নিজের টেলিভিশনের সামনে বসে মানুষ মনে করে, এখানে আমি নিরাপদ, এখানে আমাকে কেউ দেখছে না৷ নিজের ঘর, নিজের বাড়ি, এখানে বাইরের কারুর ঢোকার অধিকার নেই৷ কিন্তু স্মার্ট টিভি আসার পর এই ধারণাটা ভ্রান্ত, কেননা আধুনিক স্মার্ট টিভি শুধু ডাটা ধরতেই পারে না, ডাটা পাঠাতেও পারে৷ বিপদটা সেখানেই৷
ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউট ফর সিকিওর ইনফর্মেশন টেকনোলজি (সিট)-এর অধ্যাপক মিশায়েল ভাইডনার বলেন, ‘‘স্মার্ট টিভি বলতে লোকে বোঝে একটা টেলিভিশন, যেটা আর বিশেষ কিছু করে না অথবা করতে পারে না৷ কিন্তু স্মার্ট টিভি আসলে একটি সক্রিয় যন্ত্র, যা শোনে আর দেখে, নজরও রাখতে পারে৷ যেমন আপনি টেলিভিশনে কি দেখছেন, ইন্টারনেটে কি করছেন, ব্রাউজার কোন কাজে লাগাচ্ছেন, সেসব৷ আসল বিপদ হলো, অধিকাংশ মানুষের তা জানা নেই৷''
প্রত্যেকবার আমরা যখন আমাদের স্মার্ট টিভি চালাই বা চ্যানেল বদলাই, তখন আমাদের টিভি, সংশ্লিষ্ট ব্রডকাস্টারের ওয়েবসাইটে একটি এনকোয়্যারি পাঠায়৷ সেখান থেকে জার্মানিতে একটি ডাটা প্রাইভেসি সংক্রান্ত নোটিশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যা আমাদের জানিয়ে দেয় যে, ব্রডকাস্টার এখন আমাদের সম্বন্ধে ডাটা সংগ্রহ করছে৷ এই নোটিশ কিন্তু সাধারণত লুকনো থাকে৷ ব্রডকাস্টার যে তথ্য সংগ্রহ করছে, তা রোখারও কোনো পন্থা নেই – কিন্তু তার ফলশ্রুতি আছে৷ আইটি বিশেষজ্ঞ মার্কো ঘিগলিয়েরি বলেন, ‘‘নজরদারির ফল প্রাথমিকভাবে এই হতে পারে যে, বিশেষ করে আপনার রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বিজ্ঞাপন আপনার স্ক্রিনে ভেসে উঠবে৷ আবার নজরদারির সবচেয়ে বড় কুফল এ-ও হতে পারে যে, আপনার স্বাস্থ্য বিমা সংস্থা আপনার প্রিমিয়াম বাড়িয়ে দেবে, কেননা আপনি বড় বেশি টেলিভিশন দেখে থাকেন৷''
আপনার প্রোফাইল
আপনি কী ধরনের প্রোগ্রাম দেখতে ভালোবাসেন, তা নিয়ে আপনার একটা প্রোফাইল বানাতে পারে আপনার ব্রডকাস্টার৷ তবে অনেকে মিলে টিভি দেখলে, গোলমাল দেখা দিতে পারে৷ মার্কো ঘিগলিয়েরি-র বক্তব্য, ‘‘ব্যক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপনের অর্থ, ধরুন আপনি রাতের দিকে অ্যাকশন ফিল্ম দেখতে ভালোবাসেন৷ সেই কারণে দিনের বেলা আপনার ছেলে কিংবা মেয়েকে বন্দুকের বিজ্ঞাপন দেখানো হতে পারে৷''
স্মার্টফোনের মাধ্যমে আমরা ব্যক্তিগত তথ্যের যে পদচিহ্ন রেখে যাই, তা থেকে আজ ব্যবহারকারীর ব্যক্তিত্বের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল বানানো সম্ভব৷ সেক্ষেত্রে আমাদের মোবাইল ফোন শুধুমাত্র হিসেব রাখে, আমরা কোথায় গেছি, কী করেছি বা কিনেছি, ক'বার একটি দোকানে অথবা কোনো গির্জায় ঢুকেছি৷ আইটি বিশেষজ্ঞ এর্ভে সিমো ফোম বলেন, ‘‘আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি কিনা, খোলামেলা স্বভাবের কিনা, খুঁটিয়ে কাজ করি কিনা, এ সবই খুঁজে বের করা সম্ভব৷ মনস্তত্ত্বের ভাষায়, ব্যক্তিত্বের পাঁচটি গুণগত বৈশিষ্ট্য, যা দিয়ে মানুষকে সাধারণত যাচাই করা হয়৷''
ভেবে দেখুন, এই তথ্য যদি চাকুরিদাতা কিংবা ওপরওয়ালার হাতে পড়ে, তাহলে চাকুরির আবেদন যেমন খারিজ হতে পারে, তেমন প্রোমোশন বাতিল হতে পারে৷ ডার্মস্টাটের ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউট ফর সিকিওর ইনফরমেশন টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা প্রতিরোধের পথ খুঁজছেন, যা-তে প্রত্যেকে নিজে নির্ধারণ করতে পারেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করবেন কিনা৷
ডাটা প্রাইভেসি
ডার্মস্টাটের গবেষকরা একটি ডাটা প্রাইভেসি বক্স সৃষ্টি করেছেন, যা টেলিভিশনের পিছনে রাখলে, তা টিভি থেকে ও টিভি অভিমুখে তথ্যের আদানপ্রদানের উপর নজর রাখে৷ তথ্যের সন্দেহজনক প্রবাহ দেখলে স্ক্রিনের মাধ্যমে ইউজারকে সাবধান করে দেয়৷ মার্কো ঘিগলিয়েরি বললেন, ‘‘ডাটা প্রাইভেসি বক্সের নোটিফিকেশন দেখলেই আপনি এই সবুজ বাটন আর রিমোটের সাহায্যে নির্ধারণ করতে পারেন, টেলিভিশন ব্রডকাস্টার আপনার ডাটা পাবে কিনা৷ আপনি যদি কোনো কিছুই না করেন, সেক্ষেত্রেও ব্রডকাস্টার আপনার কোনো তথ্য পাবে না৷''
তথাকথিত ইন্টেলিজেন্ট ডোমেস্টিক অ্যাপ্লায়েন্স, যেমন হিটিং-এর থার্মোস্ট্যাট, ক্যামেরা অথবা ফিটনেস আর্মব্যান্ড, এ সব যন্ত্র ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য প্রেরণ করে থাকে৷ শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থাগুলির উচিত, তারা কি তথ্য পাচ্ছে, তা স্পষ্ট করে দেওয়া অথবা তথ্য সংগ্রহ করার অনুমতি নেওয়া – দু'টোতেই তাদের সুবিধা বৈ অসুবিধা হবে না৷ প্রফেসর ভাইডনার জানালেন, ‘‘ডাটা প্রাইভেসি, গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা আস্থা সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রাখে৷ আস্থাই হলো ব্যবসার আসল মূলধন৷ যে ব্যবসা করবে, তাকে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে হবে৷ ডাটা প্রাইভেসি ছাড়া আস্থা হয় না৷ আস্থা ছাড়া ব্যবসা হয় না৷''
সেই আস্থা যদি না থাকে, আবার ডাটা প্রাইভেসি বক্সও না থাকে, তাহলে একবার ইন্টারনেট বন্ধ রাখলেই বা ক্ষতি কী?