ভারতে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের কোর্স?
২৬ মে ২০১৮ভারতের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় বা জেএনইউ৷ মেধা ও উৎকর্ষতা নিয়ে কোনো সংশয় নেই৷ এখানে প্রতি মুহূর্তে জন্ম নেয় রাজনৈতিক অধিকারের লড়াই৷ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বামপন্থি ছাত্রছাত্রীরাই এ সব লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন৷ দেশের যে কোনো জ্বলন্ত ইস্যুতে তাই আন্দোলনে এগিয়ে আসে জেএনইউ৷ কিন্তু এমন পরম্পরায় মোটেই বিশ্বাসী নয় দেশের সরকার৷ কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এবং তাদের ‘মেন্টর' আরএসএস জেএনইউ-তে বামপন্থার অবসান ঘটিয়ে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের হাতে তুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে৷ বিজেপি এবং আরএসএস-এর জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় যেন ‘গলার কাঁটা'৷ সম্ভবত সে কারণেই কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নানা ইস্যুতে ‘টার্গেট' করা হয়েছে জেএনইউ-কে৷
সূত্রের খবর, জেএনইউ শিক্ষা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুব শীঘ্রই ‘সেন্টার ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ' নামে একটি কেন্দ্র তৈরি করবে তারা৷ আর সেখানে চালু হবে ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' কোর্স৷ অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ ও ধর্ম একই আসনে! ধর্মীয় বিদ্বেষের সঞ্চার!
জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ, বুদ্ধিজীবী এবং ধর্মনিরপেক্ষে রাজনীতিবিদ এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বহু সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই এই ধরনের কোর্স পড়ানোর ভাবনার বিরোধিতা করেছেন৷ প্রশ্ন উঠেছে, ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কোর্স চালু হলে ‘আরএসএস সন্ত্রাসবাদ' বা ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদ' নিয়ে পড়াশোনা হবে না কেন? সকলেই জানেন ভারতে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনায় একাধিক আরএসএস নেতারা অভিযুক্ত৷ তাছাড়া মধ্য-প্রাচ্যের দেশগুলিতে একতরফা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে অ্যামেরিকা৷ পেছনে রয়েছে তেলের ভাণ্ডারে ‘দাদাগিরি' করার উদ্দেশ্য৷ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের নামে নিজের ইচ্ছেমত মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে অ্যামেরিকা৷ তাহলে ‘অ্যামেরিকান সন্ত্রাসবাদ' নামে কোনো কোর্স চালু হতে পারে না? যদিও এতসবের পরে জেইনইউ কর্তৃপক্ষ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, তারা মনে করে ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' আছে৷ সেই কারণেই এই ধরনের কোর্স অত্যন্ত জরুরি৷ এসএফআই, আইসা এবং এনসিইউ-সহ একাধিক রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন এই কোর্সের বিরোধিতায় সরব হয়েছে৷ তাদের হুঁশিয়ারি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই বিদ্বেষের জন্ম দেয়, কিছুতেই এমন কোর্স চালু করতে দেওয়া হবে না৷
রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, মূলত বামপন্থাকে নিশ্চিহ্ন করা বিজেপি এবং তাদের আদর্শগত ‘মেন্টর' রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রথম ও প্রধান কাজ৷ সেই লক্ষ্যে গত চার বছর ধরে সরকারি ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে জেএনইউ-কে জব্দ করার সবরকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে৷ সেই উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষে নিজেদের পছন্দ মতো লোকদের নিয়ে এসেছে সরকার৷ নানাভাবে চলছে বামপন্থিদের দমন-পীড়ন৷ কখনও বিক্ষোভরত ছাত্রদের ‘দেশদ্রোহী' আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার, হেনস্থা করা হয়েছে৷ কখনও জেএনইউ ছাত্রীদের পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে৷ কখনও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে গায়েব করে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘু ছাত্রকে৷ কিন্তু এবার কট্টর হিন্দুত্বের প্রচারে মুসলিম-বিরোধী আবহাওয়া তৈরির ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে যুক্ত করা হচ্ছে দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে৷ পাঠ্যক্রমে ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' অন্তর্ভুক্ত করার নিন্দা করে তা রুখতে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভানেত্রী গীতা কুমারী৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এটা তো বিতর্কিত বিষয়৷ হিন্দু-মুসলিমে বিভেদের ষড়যন্ত্র৷ সন্ত্রাসবাদের আবার কোনো ধর্ম হয় নাকি? বিজেপি বা আরএসএস এমনটা চাইতেই পারে৷ তাই বলে দেশের এক নম্বর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তে কোন যুক্তিতে সম্মতি জানালেন উপাচার্য?''
বিষয়টিতে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পেয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের ১৪৫তম বৈঠকে অনেকেই আপত্তি তুলেছিলেন৷ কিন্তু আপত্তি শোনে কে! এই খবর জানিয়েছেন সেই দিনের বৈঠকে উপস্থিত বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনের নেতা সুধীর কে সুথার৷ জানাগেছে, ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' বিষয়টি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রস্তাব পেশ করেন চার সদস্যের একটি কমিটি৷ কমিটির শীর্ষে ছিলেন ‘আফ্রিকান স্টাডিজ'-এর অধ্যাপক অজয় কুমার দুবে৷ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রথমে শুধুমাত্র এম ফিল এবং পিএইচডি স্তরেই চালু হবে ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' কোর্স৷ পরে বিষয়টি এমএ-তে পড়ানো হবে৷ শুধু তা নয়, এই পাঠ্যক্রম চালু করার জন্য ইতিমধ্যেই আটজন অধ্যাপক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে৷
কথা হচ্ছিল ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন'-এর সর্বভারতীয় সভানেত্রী সুচেতা দে-র সঙ্গে৷ সমগ্র বিষয়ে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র দেকছেন তিনি৷ তাঁর কথায়, ‘‘আসলে বিজেপি এবং আরএসএস নিজেদের মতাদর্শ এভাবেই জোর করে অন্যান্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে৷ সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে একটি বিশেষ ধর্মকে জড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে আরএসএস৷''
যে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেই ‘অ্যাকাডেমিক কাইন্সিল'-এর মিটিং এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ করে দেওয়া হয়েছিল৷ বৈঠকে উপস্থিত ছিল কয়েকজন বাউন্সার৷ ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক প্রতিনিধিরা কিছু বলতে চেষ্টা করলেই তাঁদের জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ সরকার, শাসক দল ও জেএনইউ কর্তৃপক্ষের যোগসাজসে শিক্ষাঙ্গনে ‘ঘৃণার রাজনীতি' করা হচ্ছে বলে সুচেতার অভিযোগ৷ তিনি বলেন, ‘‘যেভাবেই হোক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চায় বিজেপি এবং আরএসএস৷ ভারতকে গণতান্ত্রিক দেশকে ক্রমশ ফ্যাসিস্ট একটি দেশে পরিণত করা হচ্ছে৷ কিন্তু বামপন্থি ছাত্র সংগঠন গুলি সেই উদ্দেশ্য কিছুতেই সফল হতে দেবে না৷ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে৷''
সুচেতার প্রশ্ন, ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কোর্স চালু হলে আরএসএস সন্ত্রাসবাদ হবে না কেন? বা হিন্দু সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পড়াশোনা হবে না কেন? ভারতে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনায় একাধিক আরএসএস নেতারা অভিযুক্ত৷ তাহলে পালটা কোর্স চালু হবে না কেন?
অন্যদিকে, এই খবর প্রকাশিত হতেই স্বতঃপ্রনোদিতভাবে জেএনইউ-এর রেজিস্ট্রারকে নোটিস পাঠিয়েছে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন৷ প্রস্তাবিত কোর্স সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে৷ ৫ জুন এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে বলেছে তারা৷ জানতে চেয়েছে, ঠিক কী কারণ রয়েছে এর পেছনে? কমিশনের চেয়ারম্যান জাফারুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, ‘‘এমন উদ্যোগ কেন নিল জেএনইউ? এর ভিত্তিই বা কী? আচমকা ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ' কোর্স চালুর প্রকৃত কারণ কী?'' পুরো বিষয়টির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে৷ প্রস্তাবিত কেন্দ্রে প্রস্তাবিত ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ' কোর্স অন্তর্ভুক্ত করার কোনো প্রস্তাব বা ‘কনসেপ্ট পেপার' তৈরি হয়েছে কিনা, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে৷ কমিশনের আশঙ্কা, এই কোর্স চালু হলে জেএনইউ ক্যাম্পাসে পড়ুয়াদের ওপর এবং ক্যাম্পাসের বাইরে সমাজে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য৷
ওদিকে, বৃহস্পতিবার উত্তর প্রদেশের আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি-র ছাত্র সংগঠন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাওড়েকরকে চিঠি লিখে তাঁর হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছে৷ সেইসঙ্গে জেএনইউ-তে প্রস্তাবিত ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ' কোর্স চালুর প্রস্তাব ফেরৎ নেওয়ার আর্জি জানিয়েছে৷ছাত্র সংসদের সভাপতি মকসুর আহমেদ উসমানি চিঠিতে বলেছেন, ‘‘এই ধরনের কোর্স চালুর প্রস্তাব অত্যন্ত ‘আশ্চর্যজনক' এবং ‘বিরক্তিকর'৷ জেএনইউ-র মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কীভাবে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দিচ্ছে!'' জাওড়েকরকে তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘এমন ঘটনা থেকে সরকার ও শাসক দলের লুকোনো উদ্দেশ্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে৷''
বন্ধু, ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ'-এর কোর্স কেন চালু করতে সচেষ্ট ভারত? লিখুন নীচের ঘরে৷