জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তরুণীর টিকটক
১৭ মে ২০২২‘ফিউচার' লেখা এক হুডি পরে জুম ক্যামেরার সামনে হাজির হন ভ্যালেরিয়া শাশেনক৷ কয়েক সপ্তাহে আগে ইটালির মিলান শহরে পৌঁছেছেন তিনি৷ বর্তমানে বাস করছেন এক ইটালীয় পরিবারের সঙ্গে৷ ইউক্রেন ছাড়ার আগ অবধি দেশটির রাশিয়া সীমান্তের কাছে অবস্থিত চার্নিহিউ শহরের এক বেসমেন্টে বাবামায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন কাটিয়েছেন তিনি৷
‘‘আমার মা ২৪ ফেব্রুয়ারি আমার রুমে এসে বলেন: ভ্যালেরিয়া! কিয়েভে বোমার আঘাতে একটি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে!'' বলেন শাশেনক৷ তখন তিনি এবং তার বাবামা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে একটি বেসমেন্টে চলে যান৷
সেসময় তার বাবা একটি রেস্তরোঁ চালাচ্ছিলেন এবং বেসমেন্টটি ছিল তার অফিস৷ কিছুদিন আগেই সেটি সংষ্কার করা হয়েছিল৷ সেখানে একটি শাওয়ার এবং টয়লেটও বসানো হয়েছিল৷ শাশেনক সেই বেসমেন্টে ১৭ দিন কাটিয়েছেন৷
‘‘সেখানে থাকাটা খুব ক্লান্তিকর ব্যাপার ছিল,'' বলেন ২০ বছর বয়সি এই ইউক্রেনীয় তরুণী৷ বেসমেন্টে ওয়াইফাই এবং স্মার্টফোন পাওয়ায় নিজেকে অবশ্য ভাগ্যবান মনে করেন তিনি৷
টিকটক এবং বাইরের বিশ্ব
শাশেনক একজন ডিজিটাল নেটিভ: তিনি জেনারেশন জেড এর সদস্য যারা কিনা ইন্সটাগ্রাম এবং টিকটকের সঙ্গে বড় হয়েছে৷ সোশ্যাল মিডিয়া ছিল তার কাছে বাইরের বিশ্ব দেখার জানালা৷ তবে, ইউক্রেন যুদ্ধ সেই বাস্তবতায় পরিবর্তন এনে দেয়৷ কারণ বিশ্ব তখন উল্টো তার কাছে জানতে চাচ্ছিল যে যুদ্ধের মাঝে তিনি কীভাবে টিকে আছেন৷
যুদ্ধের মাঝেই ‘‘থিংস দেট জাস্ট মেক সেন্স ইন...'' নামে একটি বাক্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ড করতে শুরু করে৷ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তাদের নিজ নিজ শহর বা একেবারেই ঘরোয়া পরিসরের সঙ্গে সম্পর্কিত অস্বাভাবিক বিষয়াদি এই ট্রেন্ডে তুলে ধরছিলেন৷ শাশেনকও সেই ট্রেন্ডে যোগ দেন এবং বাংকারে তার জীবনের নানা দিক তুলে ধরতে শুরু করেন৷
নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তিনি এমন সব বিষয় প্রকাশ করতে শুরু করেন যা শুধু একটি বম্ব শেল্টারেই অর্থ বহন করে৷ যেমন হট-এয়ার গান ব্যবহার করে চুল শুকানো, আন্ডারগ্রাউন্ডে ব্রেকফাস্ট কেমন হয় কিংবা স্টোভ ছাড়াই কটেজ চীজের প্যানকেক বানানোর উপায়৷ এসব ভিডিও দ্রুতই ভাইরাল হতে শুরু করে এবং ২০ বছরের তরুণীর অনুসারীর সংখ্যা দ্রুত ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়৷ তার একটি ভিডিও পাঁচ কোটি বার প্রদর্শিত হয়েছে৷
শেল্টার থেকে মুক্তি
টানা ১৭ দিন আন্ডারগ্রাউন্ড শেল্টারে থাকার পর এবং রুশ বাহিনী যখন হামলার পরিমান বাড়াতে শুরু করে তখন শেল্টার ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন শাশেনক৷ যদিও তার বাবামা চার্নিহিউতে রয়ে গেছেন, তিনি কিছুদিন আগে ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ড এবং জার্মানি হয়ে ইটালিতে চলে গেছেন৷ তিনি এখন সেখানে একটি পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন৷
তবে, শাশেনক দেশে থাকা তার বাবামা এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন৷ তিনি প্রতিদিন তার বাবামায়ের সঙ্গে কথা বলেন৷ বেশি কথা বলেন তার মায়ের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে কম৷
‘‘বাবা অনেক অস্থির৷ তার সারাদিন কিছু করার নেই৷ ফোনে আমার সঙ্গে চিৎকার চেচামেচি করেন৷ তবে সেটা আমাকে তিরষ্কার করতে নয়৷ আসলে তিনি ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছেন,'' বলেন শাশেনক৷
গত মার্চের শেষের দিকে শাশেনককে তার মা জানান যে তার এক আত্মীয় বোমার আঘাতে মারা গেছেন৷ রুশ ভাষা শিখতে শিখতে বড় হওয়া এই ইউক্রেনীয় তরুণী বলেন, ‘‘রাশিয়া আমাদের দেশে কী করছে? আমি প্রতিদিন নিজেকে এই প্রশ্নটি করি৷ পুটিন বলেন যে তিনি আমাদেরকে ইউক্রেনীয় সরকারের কাছ থেকে রক্ষা করতে চান৷ এটার মানে কী? আমাদের জীবনতো আগে চমৎকার ছিল৷ রাশিয়ার আমাদেরকে সুরক্ষা দেয়ার দরকার নেই৷''
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
অন্য সব ইউক্রেনীয়র মতো, শাশেনকও আশা করছেন যে যুদ্ধ শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে৷ আর তখন দেশে ফিরে যেতে চান তিনি৷
‘‘আমি আমার দেশকে মিস করছি৷ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে ফিরে যাবো,'' বলেন এই টিকটক তারকা৷
চলতি সপ্তাহে শাশেনক একটি রিডিং ট্যুরে আছেন৷ তার বই ‘‘ভিয়াউন্ডশোয়ান্সিশ ফেব্রুয়ার: উন্ড ডেয়ার হিমেল ভার নিখশ্ট মেয়ার ব্লাও'' (ফেব্রুয়ারি ২৪: এবং আকাশ আর নীল ছিল না) সম্প্রতি জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে৷ রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর নিজের অভিজ্ঞতা এবং সে সম্পর্কিত বিভিন্ন ছবি দিয়ে বইটি সাজিয়েছেন তিনি৷
‘‘আমি এই বইটি এই আশায় রুশদের উৎসর্গ করছি যেনো তারা বুঝতে পারে যে তারা আমাদের সঙ্গে কী করেছে,'' বলেন তিনি৷
তবে, রুশরা আদৌ বুঝবে কিনা তা নিয়ে শাশেনকের নিজেরই সন্দেহ আছে৷ কিছু মানুষ বুঝতে চায় না, আর কিছু মানুষ ভয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলছে না বলে মনে করেন তিনি৷ তাসত্ত্বেও নিজের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে চান ভ্যালেরিয়া শাশেনক৷ টিকটক এবং ইন্সটাগ্রামে নিজের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে চার্নিহিউ শহরে কাজ করা একটি সাহায্য সংস্থার জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন তিনি৷ ভবিষ্যতে নিজের শহর পুর্নগঠনেও কাজ করবেন এই তরুণী৷
প্রতিবেদন: রাইনা ব্রইয়ার / এআই