জিহাদিদের ফাঁদে পা দিলে চলবে না
১৯ নভেম্বর ২০১৪গত রবিবার স্বঘোষিত ‘ইসলামিক স্টেট' সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরও এক পণবন্দির শিরশ্ছেদের ভিডিও প্রকাশ করেছে৷ এবার তাদের শিকার এক মার্কিন উন্নয়ন সাহায্য কর্মী৷ কয়েক মিনিটের মধ্যে খবরটি পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ সিএনএন-এর মতো সংস্থায় তা হয়ে উঠলো ‘ব্রেকিং নিউজ'৷ ডয়চে ভেলে থেকে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর শিরোনামে স্থান পেল খবরটি৷ এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, আইএস-এর এমন সচতুর জনসংযোগের চালের মুখে এটাই সঠিক আচরণ কি না৷ শিরশ্ছেদ যতই ভয়ংকর ঘটনা হোক না কেন, বিশ্ব রাজনীতির খবরের তালিকার শীর্ষে তা শোভা পায় না৷ একটি হত্যার ঘটনা ইরাক ও সিরিয়ার পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আনে না, যেখানে আইএস তার খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়৷ আরও মারাত্মক বিষয় হলো, শিরশ্ছেদের প্রতিটি ঘটনাকে সংবাদ শিরোনামে স্থান দিয়ে আমরা আইএস-এর জনসংযোগ কৌশলের ফাঁদে পা দিচ্ছি৷
প্রতিশোধ, খ্যাতি ও প্রতিক্রিয়া
আয়ারল্যান্ডের গবেষক লুইজ রিচার্ডসন-এর মতে, যে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মতো আইএস-ও তিনটি বিষয় নিয়ে ব্যস্ত – প্রতিশোধ, খ্যাতি ও প্রতিক্রিয়া৷ প্রতিশোধ নেবার এক্তিয়ার তাদের নিজেদের হাতেই রয়েছে৷ তবে খ্যাতি ও প্রতিক্রিয়ার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না৷ তাহলে আমরা কেন শিরশ্ছেদের ঘটনা ফলাও করে তুলে ধরে আইএস-এর জন্য বিনা খরচে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করি? পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যম যদি ভবিষ্যতে শিরশ্ছেদের ঘটনাকে বেশি গুরুত্ব না দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আইএস-এর ‘পাবলিক রিলেশনস'-এর চাল ভেস্তে যাবে৷
এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া৷ দূর্ভাগ্যবশত কিছু পশ্চিমা দেশ এ ক্ষেত্রে এমন সব পরামর্শ নিয়ে ভুল পথে এগোচ্ছে, যাতে হিতে বিপরীত হয়৷ যেমন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইন্টারনেটকে জিহাদিদের এক ধরনের ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট' বলে মনে করেন৷ তাই ইন্টারনেটের উপর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দেখতে চান তিনি৷ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘‘ইন্টারনেটকে বল্গাহীন শাসনহীন এলাকা হতে দেওয়া চলবে না৷'' ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা জিসিএইচকিউ-এর নতুন প্রধান রবার্ট হ্যানিগ্যান সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ফেসবুক ও টুইটার সন্ত্রাসবাদীদের নতুন কন্ট্রোল রুম হয়ে উঠেছে৷ ক্যামেরন আর মনে করেন, সেন্সরশিপ চালিয়ে ইন্টারনেট থেকে চরমপন্থি কন্টেন্ট সরিয়ে ফেলা কোম্পানিগুলির ‘সামাজিক দায়িত্ব' হওয়া উচিত৷
তথ্য সংগ্রহের কাজে সোশাল মিডিয়া
তাঁরা সবাই ভুলে যাচ্ছেন, যে সেই একই সোশাল মিডিয়া ঘেঁটেই সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা যায়৷ জেরেমি শাপিরো ও ড্যান বাইম্যান নামের দুই মার্কিন বিশেষজ্ঞ তা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন৷ গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কমপক্ষে জিহাদিদের ‘রিক্রুটমেন্ট'-এর গুরুত্বপূর্ণ পথগুলি সম্পর্কে জানা উচিত৷ আরও এক ধাপ এগিয়ে তারা বর্তমান ও সম্ভাব্য জিহাদিদের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ভুল তথ্য সরবরাহ পারে৷ সেন্সরের থাবা আরও প্রসারিত করলে সে সব কিছুই সম্ভব হবে না৷
আরও মারাত্মক পরামর্শ এসেছে ব্রিটিশ জিসিএইচকিউ ও মার্কিন এফবিআই-এর শীর্ষ কর্তাদের কাছ থেকে৷ তাঁরা সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা ও বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির মধ্যে আরও নিবিড় সহযোগিতার ডাক দিয়েছেন৷ জিসিএইচকিউ প্রধান হ্যানিগ্যান টেক কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীরা তাদের পরিষেবার অপব্যবহার করছে৷ অথচ তারা এ কথা গোপন করছে৷ তাঁর ক্রোধের অন্যতম কারণ এনক্রিপশন টুলস, যার ফলে সরাসরি আড়িপাতা কঠিন হয়ে ওঠে৷ হ্যানিগ্যান বলেন, অতীতে তথ্যের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এমন এনক্রিপশন বা পরিচয় গোপন করার প্রযুক্তি হাতে গোনা কিছু দক্ষ অপরাধী ও রাষ্ট্রের হাতে সীমাবদ্ধ ছিলো৷ আজ মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি প্রায় সব ক্ষেত্রেই এনক্রিপশন প্রয়োগ করছে৷ ফলে তা সবার নাগালে চলে এসেছে৷ এফবিআই প্রধান জেমস বি কমি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘‘এনক্রিপশন আমাদের সবাইকে অত্যন্ত অন্ধকার এক জগতে নিয়ে যাবে৷'' হ্যানিগ্যান ও কমি চান, এনক্রিপশন হয় পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হোক, অথবা তার চাবি খোলার প্রযুক্তি গোয়েন্দা সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়া হোক৷ অথচ নজরদারি এড়াতে এনক্রিপশন আজ সাংবাদিক, সরকার বিরোধী ও নাগরিকদের একমাত্র হাতিয়ার৷
নিজস্ব আদর্শ জলাঞ্জলি দিলে চলবে না
আইএস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বাস্তব চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে, তার প্রেক্ষাপটে এই সব হাতিয়ার নিষিদ্ধ করা বা সেগুলি ভোঁতা করে দেওয়া হবে এক ভুল প্রতিক্রিয়া৷ নাইন ইলেভেনের পর আমরা যেমন হ্যানিগ্যান ও কমি-র মতো মানুষদের একপেশে অ্যাজেন্ডার জন্য ব্ল্যাংক চেক লিখে দিয়েছিলাম, এবার সেটা করা উচিত হবে না৷ মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলি নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে পারে না৷ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম'-এর এক দশক পর এটাই মূল শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত৷