জার্মানির রাজনীতিকেরা কি শিক্ষা নেবেন?
৫ মার্চ ২০১৮যাকে বলে, খাদের কিনার থেকে উঠে আসা৷ আশা যখন প্রায় অস্ত যেতে বসেছিল, ঠিক তখনই সমাধানসূত্র মিললো৷ জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা এসপিডি মহাজোটের পক্ষে সমর্থনসূচক ভোট দিলো৷ জানা গেছে, মার্চের শেষ সপ্তাহের আগেই নতুন সরকার তৈরি হয়ে যাবে৷ সম্ভবত ইস্টারের আগেই৷
তবে এই সমাধান সূত্রে পৌঁছানো সহজ ছিল না৷ জোট আলোচনা থেকে জোট সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত, কোনো বিষয়ই খুব সহজে হয়নি৷ এসপিডি'র তারকা রাজনীতিক মার্টিন স্কুলৎসও সমস্যার প্রাথমিক সমাধান করতে পারেননি৷ অন্যদিকে আঙ্গেলা ম্যার্কেলও যথেষ্ট চাপের মধ্যে ছিলেন৷ কারণ, জোট না হলে তাঁর পক্ষে আরো একবার ক্ষমতায় আসা সম্ভব ছিল না৷ কারণ, তাঁর দলও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি৷ ফলে জোট রাজনীতির এই নতুন বিশ্বে অন্যান্য দলের ওপর তাঁকে ভরসা করতেই হচ্ছিলো৷
জার্মানির রাজনীতিতে এ এক নতুন অধ্যায়৷ ১৯৪৯ সালে জার্মান ফেডেরাল রিপাবলিক তৈরি হয়৷ সেই তখন থেকেই জার্মানির প্রধান দু'টি দল কখনো মিলেঝুলে সরকার গঠন করেছে, কখনো একক ক্ষমতাতে সরকারে এসেছে৷ গত ১২ বছরে বিষয়টি আরো সহজ হয়ে গিয়েছিল৷ ম্যার্কেল চ্যান্সেলর থেকেছেন৷ জার্মানির রাজনীতিতেও চোখে পড়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি৷
অঙ্ক জটিল করে দিয়েছে জার্মান রাজনীতিতে হঠাৎ করে প্রাধান্য পেয়ে যাওয়া অতি দক্ষিণপন্থি এএফডি পার্টি৷ সংসদেও তারা নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে৷ আগে যে সমস্ত দলকে বড় বলে মনে করা হতো, গত নির্বাচনে তারা ছোট দলে পরিণত হয়েছে৷ আর এএফডি'র মতো নগণ্য দলগুলি হঠাৎ করে বড় হয়ে উঠেছে৷ এর ফলে সরকার তৈরির অঙ্কগুলিই বদলে গিয়েছিল৷
পরিচয়ের খোঁজে জার্মানি
নতুন করে উদ্ভূত এই পরিস্থিতিই জার্মানির বর্তমান অবস্থাটি স্পষ্ট করে দেয়৷ গত কয়েক দশকে জার্মানির মূল রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিরাপদ ভোটারদের এতটাই বিতশ্রদ্ধ করে তুলেছে যে, এখন তাঁরা নিজেদের মতামত বদলে ফেলেছেন৷ জার্মানদের বর্তমান পরিস্থিতি, ভয়, ভাবনা কোনো কিছুকেই সেভাবে বুঝতে চাইছে না পুরনো দলগুলি৷ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছে না তারা৷ জার্মানদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, তাঁরা যেভাবে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত, সেখানে একটা হুমকি তৈরি হয়েছে৷ মূলস্রোতের রাজনীতিকেরা জার্মান জনগণকে বোঝাতে পারছে না, কীভাবে বিশ্বায়িত বিশ্বের সামনে জার্মান পরিচয়, মূল্যবোধ, সংস্কৃতিকে খাপ খাইয়ে নেওয়া হবে৷
ট্রাম্প- শি জিন পিং-পুটিনের বিশ্বে জার্মানির অবস্থান কী হবে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে জার্মানির জায়গা ঠিক কোন জায়গায়, কী তার বিদেশনীতি, কী তার অর্থনৈতিক ভাবনা, এর কোনো কিছুই মানুষকে বোঝাতে পারছে না মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলি৷
সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানির নির্বাচন হয়েছিল৷ মার্চ পর্যন্ত সরকার তৈরি করা যায়নি৷ এই সময় পর্বে যে ঝড় বয়ে গেল জার্মান রাজনীতিতে, তার থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত রাজনীতিকদের৷ রাজনীতিবিদদের সাধারণ মানুষের কথা শুনতে হবে৷ মানুষকে বোঝাতে হবে, তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে৷ রাজনীতিকদের মানুষের কথা বুঝতে হবে৷ তাদের ভাবনাগুলো ধরতে হবে৷ পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে পুরনো এবং ভয়ংকর জাতীয়বাদের ধোঁয়া যাতে আবার ফিরে না আসে৷ পাশাপাশি মহাজোটকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে জোটের প্রত্যেকটি দল তাদের নিজেদের বিশেষত্ব, নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান আলাদা রাখতে পারে৷ নইলে নিজেদের ভোটারদের কিন্তু ধরে রাখা যাবে না৷
মহাজোটের আলাদা আলাদা দলগুলি নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে না পারলে দু'টি দলই আগামী দিনে আরও ডুববে৷ নিজেদের ভোটারদের আরো বেশি করে হারাবে তারা৷ অন্যদিকে এএফডি'র মতো অতি দক্ষিণপন্থি দলগুলি নিজেদের দিকে আরো বেশি ভোটার টেনে নেবে৷
জরুরি অ্যালার্ম
আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবার সরকার গঠন করতে পারেন৷ এতদিনের এই টালমাটাল স্পষ্ট করে দেয়, জার্মান রাজনীতিকদের সবকিছু নতুন করে গোছাতে হবে৷ এএফডি সংসদে ঢুকে পড়েছে৷ ফলে বুন্দেসটাগ বা জার্মান সংসদের চেহারা এবার অনেকটাই বদলাবে৷ বদলাবে সংসদের সংস্কৃতি৷ গ্রিন পার্টির রাজনীতিক চেম ও্যজদেমি'র অসাধারণ বক্তৃতা ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছে, কীভাবে ঘৃণা এবং বিতারণের রাজনীতির সঙ্গে জুঝতে হবে৷ তুরস্কের শরণার্থীর সন্তান ও্যজদেমি বুঝিয়ে দিয়েছেন, পুরনো নাৎসি ভাবাদর্শ নয়, জার্মানির সংস্কৃতি, সম্মান, ঐতিহ্য আসলে জড়িয়ে সকলকে একসঙ্গে নিয়ে বাঁচার মধ্যে৷ অনেকদিন এত সুন্দর বক্তৃতা শোনা যায়নি জার্মান রাজনীতিকদের মুখ থেকে৷ যুক্তি দিয়ে লড়াই করতে হবে৷ একসময় বলা হতো, জার্মান রাজনীতিতে বিকল্প নেই৷ সেই দিন শেষ৷ একদিকে ভালো হয়েছে৷ শক্তিশালী প্রতিপক্ষ থাকলে সরকারে থাকা দলগুলি সচেতন থাকবে এবং মানুষের কথা ভাববে৷
আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷
ইনেস পোল/এসজি