সাংবাদিকতা
২৮ জুলাই ২০১২‘লাইমলাইট'এ থাকার আকাঙ্ক্ষা
রাজনীতিক, খেলোয়াড়, অভিনেতা, শিল্পী – প্রায় সবাই চান, তাদের ঘিরে আলাপ-আলোচনা হোক, চর্চা হোক, পত্রপত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হোক, টেলিভিশনের পর্দায় তাদের দেখানো হোক৷ কিন্তু তা হতে হবে তাদের পছন্দমতো৷ বেফাঁস মন্তব্য, কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি – এ সব যেন দূরে থাকে৷ অন্যদিকে সংবাদ মাধ্যম চায় এমন খবর, যা শ্রোতা, পাঠক বা দর্শকের মনে ধরবে৷ প্রশ্ন হলো, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য কি আদৌ সম্ভব?
জার্মানির ফুটবল তারকা লুকাস পডলস্কি'র কথাই ধরা যাক৷ আজকাল তাঁর মন-মেজাজ একেবারেই ভালো নেই৷ কারণ তাঁর একটি সাক্ষাৎকার, যা সবে ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে৷ তাও আবার ইএসপিএন'এর মতো নাম করা সংস্থার ওয়েবসাইটে৷ পডলস্কি বলছেন, তিনি ইএসপিএন'কে আদৌ কোনো সাক্ষাৎকার দেন নি৷ তবে এমন ঘটনা একেবারে বিরল নয়৷ বিখ্যাত মানুষ বনাম সাংবাদিকের সংঘাতের একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে৷
সংঘাতের কাঠামগত সমাধান
তবে দেশটা জার্মানি বলে কথা৷ সমস্যা দেখা দিলেই শুধু তার সমাধান নয়, দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে একটা সমাধানসূত্রের খোঁজ পড়ে৷ তারপর একটা কাঠামোর মধ্যে ভরে ফেলা হয়, যাতে ভবিষ্যতে আর এ নিয়ে হইচই না হয়৷ সাক্ষাৎকারের পর কেউ বলতেই পারেন, ‘‘আমাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে'', বা ‘‘সঠিক প্রেক্ষাপটের উল্লেখ না করে একটি বাক্য তুলে ধরা হয়েছে৷''
এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে৷ এমন পরিস্থিতি এড়াতে কোনো সাংবাদিক সেই বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে একটি বোঝাপড়া করতে পারেন৷ অর্থাৎ সাক্ষাৎকার নেবার আগেই দুজনে কিছু শর্ত নিয়ে দর কষাকষি করে একটি বোঝাপড়ায় আসতে পারেন৷ যেমন বিখ্যাত মানুষটি বলতে পারেন, ‘‘সাক্ষাৎকারের পর আমাকে তার লিখিত সংস্করণ দেখাতে হবে৷ প্রয়োজনে আমি কিছু রদবদল করতে পারবো৷ তার পরেই সেটি ছাপা যাবে৷''
জার্মানিতে আজকাল প্রায় সব বিখ্যাত মানুষই এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন৷ এমন বোঝাপড়া ছাড়া তাঁরা কোনো সাক্ষাৎকার দেন না বললেই চলে৷ সাংবাদিকরাও এটা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন৷ তাঁরা চট করে এ সব মানুষকে চটাতে চান না৷
বোঝাপড়ার সমালোচনা
জার্মানির প্রেস কাউন্সিলের প্রধান লুৎস টিলমানস এই প্রবণতাকে মোটেই সহজে মেনে নিতে পারছেন না৷ তিনি বললে ‘‘আমার কাছে যেটা সবচেয়ে গোলমেলে বিষয় মনে হয়, সেটা হলো রাজনীতিক ও বিখ্যাত মানুষেরা এর ফায়দা তুলছেন এবং তারা এই চুক্তির মাধ্যমে সাংবাদিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করছেন৷ তাঁরা চান, সাক্ষাৎকার দেবার পর অপ্রিয় বিষয়গুলি কাটছাঁট করে সেটিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হোক৷''
২০০৩ সালে বার্লিনের দৈনিক ‘টাগেসসাইটুং'এ একটি সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে চরম বিতর্কের ঝড় উঠেছিল৷ বামপন্থী এই সংবাদপত্রকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডি দলের নেতা ওলাফ শলৎস৷ এর ঠিক পর পরই তিনি কয়েকটি অংশ বাদ দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু ‘টাগেসসাইটুং' সেই আবদার না মেনে গোটা সাক্ষাৎকারটিই প্রকাশ করে৷ তাদের উদ্দেশ্যই ছিল এই বোঝাপড়ার বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা৷
ভুল উদ্ধৃতির বিপদ
তবে এই বোঝাপড়ার রীতির অন্য দিক তুলে ধরলেন জার্মানিতে মুখপাত্রদের কেন্দ্রীয় সংগঠনের উভে ডল্ডারার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘দেখুন, আমার কাছে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট৷ যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, তিনি যা বলছেন সেই কথার উপর তাঁর অধিকার আছে৷ সাংবাদিক যেমন বলতে পারেন, সেই সাক্ষাৎকার ছাপা বা না ছাপার বিষয়ে তাঁরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে, যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, তাঁরও বলার সুযোগ থাকা উচিত – আমি কথাটা এভাবে বলতে চাই নি বা বলি নি৷''
অর্থাৎ ডল্ডারার মনে করেন, যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, শেষ কথা বলার অধিকার তাঁরই থাকা উচিত৷ কারণ বিশেষ করে সংবাদপত্রে জায়গার অভাবে প্রায়ই সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ ছাপা হয়, বিশেষ কিছু চমকপ্রদ বিষয় তুলে ধরা হয়৷ কিন্তু সমস্যা হলো, প্রতিযোগিতার এই বাজারে শুধু বড় আকারের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন কেন্দ্রগুলিই এমন বোঝাপড়ার বদলে বিখ্যাত মানুষদের সাক্ষাৎকার নিতে পারে৷ জার্মানির প্রেস কাউন্সিলের প্রধান লুৎস টিলমানস বিষয়টিকে ব্ল্যাকমেল হিসেবে বর্ণনা না করলেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে দৈনন্দিন সমস্যা হিসেবে দেখেন৷
সমাধানসূত্র কী?
তাহলে এই অচলাবস্থার সমাধানসূত্র কী হতে পারে? কার স্বার্থ রক্ষা করা বেশি জরুরি – যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, তিনি নাকি সাংবাদিকের? এর কোনো সহজ উত্তর নেই৷ দ্রুত সংবাদ পরিবেশনের এই যুগে কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই মানুষকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে৷ এমন ত্রুটি সংশোধন করাও বেশ কঠিন৷ বাকিরা বলছেন, সাংবাদিকদেরও সবসময় আবদার না মেনে পাল্টা চাপ দেওয়া উচিত৷ যে কোনো মূল্যে সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেয়ে সাংবাদিকতার মানদণ্ড রক্ষা করা অনেক বেশি জরুরি৷
প্রতিবেদন: নিকোলাউস স্টাইনার / এসবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ