জার্মানিতে মসজিদ ঘুরিয়ে দেখান এক প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান
১০ এপ্রিল ২০০৯অক্টোবর মাসে ডুইসবুর্গ শহরের এই মসজিদটি উদ্বোধন করা হয়৷ নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ইয়ুর্গেন রুটগার্স সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷ প্রায় ৩ বছর সময় লেগেছে এই মসজিদ নির্মাণে৷ ১,৪০০ মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন সেখানে৷ আর উদ্বোধনের পর থেকেই ডুইসবুর্গ শহরের সেই মসজিদটি দেখার জন্য প্রতিদিনই ভীড় করছে হাজারো দর্শনার্থী৷ জার্মানির মতো দেশের জন্য এ এক অবাক করার বিষয় তো বটেই !
ডুইসবুর্গ-মার্ক্সলোর এই মসজিদটির উচ্চতা প্রায় ২৩ মিটার৷ মসজিদের প্রধান দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে নিখুঁত চিত্র৷ নীল কাচের সুক্ষ্ম জানালা, গম্বুজের সঙ্গে ঝোলানো রয়েছে মস্ত সোনালী রঙের সব ঝাড়বাতি৷ সে সব ছেড়ে এগিয়ে যেতে হয় মসজিদে৷ মেঝেতে বিছানো নরম ফারের কার্পেট৷ যার ওপর গোল করে বসেছেন ডরিস বেরেন্সাইমারের বন্ধুরা৷ রাইন নদীর ধারে অবস্থিত একটি ছোট্ট শহর হ্যুনক্সে থেকে ডরিস তাঁর বন্ধুদের মসজিদটি দেখাতে নিয়ে এসেছেন৷ কেন ?
ডরিস জানান, আমার মনে হয়েছে, ভয়টা কাটিয়ে ওঠার জন্য যাই না কেন মসজিদের ভিতরে৷ গিয়ে আমরা দেখি কোন্ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করা হচ্ছে৷ শুনি তাদের কথা৷ আসলে এই মসজিদটাকে তো সবসময়ই সবচেয়ে বড় মসজিদ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে৷ আর তা থেকেই ভয়ের সূত্রপাত৷ কিন্তু আমরা যখন ভিতরে গেলাম, দেখলাম ভয়ের কোন ব্যাপারই নেই৷ ভিতরে বরং দারুণ এক অনুভূতি হয়৷ খুবই সুন্দর জায়গাটা৷ আর কী সুন্দর সাজানো৷ সবার কীরকম বন্ধুর মত ব্যবহার৷
শুধু ডরিস কেন? প্রতি মাসেই ২০০০ থেকে ২৫০০ দশর্নার্থী এসে থাকে জার্মানির বৃহত্তম এই মসজিদটি দেখার জন্য৷ তবে এদের মধ্যে সকলেই যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী তা কিন্তু নয়৷ তাই অমুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়াও ২৬ বছর বয়স্ক ক্রিস্টিন সাবরিনা ফোরব্যার্গ-এর অন্যতম একটি কাজ৷ ক্রিস্টিন ইসলামের নানা দিক নিয়ে পড়াশুনা করছেন এবং একই সঙ্গে গত প্রায় এক বছর ধরে এই মসজিদ প্রাঙ্গনেও কাজ করছেন ক্রিস্টিন৷ জার্মান এবং তুর্কি - প্রধানত, এই দুটি ভাষায়৷ কবে থেকে তিনি ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত? এ প্রশ্নের উত্তরে ক্রিস্টিন বলেন, নিম্ন রাইন এলাকার এক গ্রামের লোক আমি৷ সেখানে বিদেশী নেই বললেই চলে৷ ১৯৯০ সালে সেখানে আশ্রয়প্রার্থীদের একটি আবাসে হামলা হয়েছিল৷ আমার স্কুলের দুই বন্ধু তাতে গুরুতর আহত হয়৷ এই হামলায় তারা প্রায় মারা যাচ্ছিল আর কি৷
কি কারণে মানুষ এমনটা করে ? মনে মনেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিল সেদিনের সেই আট বছরের ক্রিস্টিন৷ এরপর ক্রিস্টিনের যখন ১৫ বছর বয়েস, তখন থেকেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের সঙ্গে একটুতেই তর্ক বেধে যেত ক্রিস্টিনের৷ বিতর্ক চলতো ধর্মের নানা দিক, আধ্যাত্মিকতা, মানবতাবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে৷ মানুষে-মানুষে কেন এতো বিভেদ? ধর্মে-ধর্মে পার্থক্য কোথায়? কোথায়ই বা তার মেলবন্ধন? এই সব প্রশ্ন৷ কিন্তু, কোনোটারই সঠিক উত্তর খুঁজে পান না ক্রিস্টিন৷
তারপর যেমন ভাবা তেমন কাজ৷ ভর্তি হয়ে যান তিনি ডুইসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ বিষয় - রাষ্ট্র বিজ্ঞান৷ কিন্তু, রাজনীতির কচকচি ক্রিস্টিনের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়৷ তাই তিনি যান বোখুম শহরে৷ শুরু করেন ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা৷ আর সেই পড়শোনা শেষ করার আগেই, মার্ক্সলো এলাকায় অবস্থিত মের্কেজ মসজিদে নিজের শিক্ষাকে হাতে নাতে পরখ করার সুযোগ পেয়ে যান ক্রিস্টিন৷ প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে৷ আর সেখান থেকেই শুরু হয় ক্রিস্টিনের গাইডের জীবন৷ ক্রিস্টিনের কথায়, সে ছিল ২০০৭-এর বসন্তকাল৷ গাইড হিসেবে প্রথম কাজ করার সময় আমি সবে ছ'দিন হয়েছে এখানে এসেছি৷ মার্ল থেকে এবং তুরস্কের একটি শহর থেকে আসা মিশ্র এক গ্রুপকে পেয়েছিলাম আমি৷ এই গ্রুপ মনে করেছিল যে, স্বজাতীয় তুর্কীরাই তাদের ঘুরিয়ে দেখাবে৷ কিন্তু তারা এসে দেখল যে আমি দু ভাষাতেই তাদের ঘুরিয়ে সব কিছু দেখাতে পারছি৷ শেষ হবার পর ওরা আমাকে ধন্যবাদ হিসেবে কোরআন শরীফ আর একটা মাথার চাদর উপহার দেয়৷
অবশ্য উপহার গ্রহণ করলেও, ক্রিস্টিন কিন্তু কোন দিনই তাঁর কাজের সময় মাথা ঢাকেন নি৷ ক্রিস্টিনের কথায়, এখনও কিন্তু তিনি একজন দৃঢ়চিত্ত প্রোটেস্টান্ট৷ কিন্তু, তাতে কোন সমস্যা নেই ক্রিস্টিনের৷ শুরুর দিকে দিনে অন্ততপক্ষে ছয়টি দলকে মসজিদ ঘুরিয়ে দেখাতে হতো ক্রিস্টিনের৷ কিন্তু, এখন সপ্তাহে মাত্র দুবার এই কাজ করতে হয় তাঁকে৷ কারণ, এখন তিনি যে আর প্রশিক্ষণার্থী নন৷ বরং এক্কেবারে নিয়মিত কর্মী৷ তাই অবসর সময়ে ক্রিস্টিন ডুইসবুর্গের শিক্ষা বিষয়ক কর্মকর্তা জেহরা ইলমাজ-এর সঙ্গে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বিষয়ে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান৷
অন্যদিকে, ক্রিস্টিনের সঙ্গে কাজ করতে পারায় প্রোটেস্টান্ট ধর্মতত্ত্বের ছাত্রী জেহরা ইলমাজ-এর কিন্তু আখেরে লাভই হয়৷ ইলমাজ জানান, আমরা যে ধর্মীয় দিকটাকেই প্রাধান্য দেই তা কিন্তু নয়৷ বরং আমরা দেখি আমাদের ধ্যানধারণাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে কারা, পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যাপারটাকে কারা সমর্থন করছে, সংলাপের পক্ষে কারা, কারাই বা তার পথ প্রশস্ত করতে সক্রিয়৷ আমরা ফোরবেয়ার্গ-এর মাঝে দারুণ এক মানুষ খুঁজে পেয়েছি৷ এঁদের মত মানুষই আমাদের অনেক বেশি দরকার৷ আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যতের জন্য এটা একটা মৌলিক পূর্বশর্ত৷
তাই আন্তঃধর্মীয় যোগাযোগের এই বিশেষ জায়গাটির সঙ্গে একজন খ্রিস্টান গাইড হিসেবে সাবরিনা ফোরবেয়ার্গ খুব ভালভাবেই খাপ খেয়ে গেছেন৷ ডুইসবুর্গ সংলগ্ন আর একটি এলাকা হামবর্ন-এর ডেপুটি মেয়র ক্রিস্টিনে বেকারও সে কথা মনে করেন৷ প্রায়ই এই মসজিদে আসেন তিনি৷ তাঁর কথায় : এই মসজিদকে মার্ক্সলোর বিস্ময় বলে অভিহিত করেন অনেকে৷ সেটাতো আর এমনি এমনি নয়৷ এর বিশেষত্ব - গোড়া থেকেই এ মসজিদ এরক ধরণের মিলনকেন্দ্র হয়ে আছে৷ এখানকার সাংগঠনিক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন খ্রিস্টীয় গির্জা এবং জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে৷
প্রতিবেদক: দেবারতি গুহ, সম্পাদনা: আবদুল্লাহ আল-ফারুক