জার্মানিতে বিদেশি রাজনৈতিক সংগঠনের বৈধতা
২০ ডিসেম্বর ২০১৯অর্থাৎ রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিকের এক অভিন্ন সত্তা গড়ে উঠেছে এদেশের সংবিধান পাস হবার সাথে সাথেই (১৯৪৯ থেকে) দেশটাকে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে দাঁড় করানোর জন্য এক মৈত্রীতন্ত্রের মোহ সেই থেকে বিদ্যমান৷
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাবে দলবদ্ধভাবে কোনো দাবি আদায়ের দৃষ্টান্ত খুবই বিরল ঘটনা৷ এদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ বলে যুব সংগঠনগুলি কম-বেশি স্বতন্ত্রভাবে সক্রিয়৷ তাই প্রতিষ্ঠিত কোনো রাজনৈতিক দল বা তার যুব, ছাত্র, কৃষক, নারী বা অন্য কোনো সংগঠনের ছত্রছায়ায় থাকাটাই অনেক সহজ৷ সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সাধারণত নিজেদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে৷ নীচের স্তর থেকে উপরে দলের গতি নির্ধারণের ঘটনার কথা কখনো এদেশে শোনা যায় না৷
আর দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতি মানেই দলীয় রাজনীতি৷ অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমমনা মানুষেরা জোটবদ্ধ হয়ে কোনো লক্ষ্য পূরণ করার উদ্দেশ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দলীয় রাজনীতি করে থাকে৷
জার্মানিতে বিদেশি ছাত্র সংঠনের বা রাজনৈতিক সংঠনের নামে কোনো দলীয় কার্যক্রম চোখে পড়ে না, বা সেসব দলের অনুমোদনও দেওয়া হয়না৷ সামাজিক সাংস্কৃতিক এমনকি ইদানিং ধর্মীয় সংগঠন করার অধিকারও রয়েছে এখানে৷ তবে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে আদালতে নিবন্ধন করতে হয়৷ আর নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় নামকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, অর্থাৎ সরাসরি মসজিদ, মন্দির বা প্যাগোডা হিসেবে নিবন্ধন করা যাবে না, তবে প্রার্থনাগার হিসেবে নিবন্ধন করতে হয় জার্মান ভাষায় যা Eingetragener Verein (e.V.) নিবন্ধিত সমিতি হিসেবে রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়৷
বিদেশি ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোও সেভাবেই রেজিস্ট্রেশন করে৷ রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিও বেশ জটিল, এক্ষেত্রে সংগঠনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যে প্রধান ভূমিকায় থাকে৷ কেবল নিজ দেশের রাজনীতি করার জন্য জার্মানির মাটিতে নিবন্ধীকরণ সম্ভব নয়৷
নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলি, বাংলাদেশ সমিতি যখন ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে নিবন্ধীকরণ হয় তখন আমি ছাত্র৷ এক্সিকিউটিভ কমিটতে সাত জন সদস্য৷ নিবন্ধন করতে আদালতে (Amtsgericht) একজন আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করতে হয়, আমাদের সেসময় সমিতির নামসহ সংবিধান দুবার সংশোধন করতে হয়েছিল৷ বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি এই নাম বদলে বাংলাদেশ সমিতি লিখতে হয় আর আদর্শ উদ্দেশ্যের মধ্যে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করাতে হয়৷ তাই এখন যখন দেখি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বা বাংলাদেশ ছাত্রদল হিসেবে জার্মানিতে প্রচার চালানো হয় তখন অন্তত এটুকু বুঝি সেগুলো জার্মানিতে রেজিষ্ট্রেশন করা সংগঠন হতে পারে না৷
মাইগ্রেশন ব্যাকগ্রাউন্ড সহ যে জনগোষ্ঠীর লোকেরা একটি সংঘ, সমিতি বা ক্লাব আকারে জার্মানিতে নিজেকে সংগঠিত করতে চান, তাদের কিছু সাংবিধানিক নিয়ম মেনে চলতে হয়৷ পাশাপাশি এইসব ক্লাবগুলোর কার্যকলাপ এই আইনের ভৌগলিক সীমারেখা পর্যন্ত প্রসারিত৷ ইদানিং সমিতি রেজিস্ট্রেশন এর ক্ষেত্রে আরো কঠোরতা অবলম্বন করেছে জার্মান সরকার, জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভের পর থেকেই৷ আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন করে নিজ দেশের রাজনৈতিক কার্যকলাপ জার্মানিতে চালানো সম্ভব নয়৷
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আইনদ্বারা এটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে জার্মানিতে বিদেশিরাও উভয়ই সমিতি গঠন করে এবং নির্বাহী বোর্ডের পদগুলিও ধরে রাখতে পারে তবে অন্যদেশের রাজনৈতিক সংঠন হিসেবে নিবন্ধন করা যাবে না৷
আর একটি উদাহারণ দেই, আইন অনুসারে বিদেশি রাজনীতিবিদদের জার্মানিতে সভা সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার কোনও অধিকার নেই, ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত স্পষ্ট করেছে যে সরকার বিদেশি রাজনীতিবিদদের প্রবেশ এবং সভা-সমাবেশ করতে নিষেধ করতে পারে৷ তাদের কেবল ব্যক্তি হিসাবে কথা বলার অধিকার রয়েছে৷
বিদেশি সরকার বা বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদের জার্মানিতে রাজনৈতিক জনসভায় কথা বলার অধিকার নেই, অন্তত সরকারি ক্ষমতায় থেকে৷ ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে, ফেডারেল সরকারকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ তবে বিচারকেরা যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশি রাজনীতিবিদদের কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা দায়ের করা যায় না৷ ওবারহাউসনের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইল্ডারামের ২০১৮ সালে উপস্থিতি ও বক্তৃতা দেওয়াতে বাধা দিয়েছিল জার্মান পুলিশ৷ অভিযোগ ছিল, তুর্কি সরকার জার্মানিতে বিতর্কিত সাংবিধানিক সংস্কার প্রচার করতে চায়, কারণ এখানে তুরস্কের বংশোদ্ভুত অনেকের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে, তা ম্যানিপুলেট করা যাবে না৷
এখন প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশের রাজনীতিবীদরা যখন সফরে এসে রাজনৈতিক সভা করেন সেটা কি বৈধ? উত্তর হলো সেটিও বৈধ নয়৷ তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জার্মান সফরে এসে এদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সাথে মতবিনিময় বৈধ৷ কারণ তা দলীয় সভা নয় বা শুধু তাঁর দলের সদস্যদের উদ্দেশ্যে সভা নয়৷ তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জার্মানিতে এসে দলীয় জনসভার আহ্বান করলে তা অবৈধ হবে৷ ঠিক এমনটি সম্প্রতি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একাডেমিক সেমিনার ভণ্ডুল করার জন্যে একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরা চড়াও হয়েছিলো যা ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ৷ এর মধ্যেই সে ব্যাপারে হাইডেলবার্গ বিশবিদ্যালয় আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷