জার্মানিতে পথে থাকে ত্রিশ হাজার গৃহহীন মানুষ
৬ এপ্রিল ২০১১এ এক অন্য রকম জায়গা৷ সেখানে সাধারণত কেউ থাকেন না৷ থাকেন শুধু এমন মানুষেরা, যাঁদের নেই কোনো থাকার জায়গা, নেই খাবারের ব্যবস্থা করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ৷ কেউ কেউ বলে তাঁরা ভবঘুরে, কেউ বলে অলস৷ এরা কিন্তু নিজেদের কোনো গোত্রে ফেলতে রাজি নন৷ তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের কাজ দিন, থাকবার জায়গা দিন, আমরা রাস্তায় থাকবো না৷''
পল বসে ছিলেন কোলন শহরের রাইন নদী ঘেষা একটি জায়গায়৷ নদী যেভাবে বয়ে চলে, ঠিক একই ভাবে বয়ে গেছে পলের জীবন৷ হাঙ্গেরিতে একজন ট্রাক ড্রাইভার হিসাবে কাজ করতেন তিনি৷ ভাগ্যের নির্মমতা তাঁকে প্রথমে টেনে নিয়ে যায় অস্টিয়া এরপর স্পেন এবং ডেনমার্কে৷ কিন্তু কোথাও কোন ভালো কিছু করতে পারেন নি তিনি৷ তারপর চলে এলেন জার্মানিতে৷ না, এখানেও ভাগ্য খুললো না তাঁর৷ আশ্রয় নিলেন কোলন শহরের এক জায়গায়৷ রাইন নদীর তীর ঘেষা আর কোলনের মূল ডোমের কাছে ঐ জায়গাটিকে বলা হয় ‘বাড়ি হারাদের বাড়ি'৷ না আদতে তাঁরা কোন বাড়িতে থাকেন না৷ তাই রাস্তাকেই বাড়ি হিসাবে ভাবতে শুরু করেন তাঁরা৷
পলের কথায়, ‘‘সত্যিই এক দীর্ঘ খারাপ সময় চলছে আমার৷ কী করবো আমি, ভেবে পাই না৷ সময় চলে যাচ্ছে৷ প্রতি দিন বাঁচার জন্য নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নিতে হচ্ছে৷ এই ধরণের অভিজ্ঞতা এক দুই দিন নিলে কোন ক্ষতি নেই৷ কিন্তু দিনের পর দিন সত্যিই অন্যরকম৷''
সিগারেটের ধোঁয়ার কটু গন্ধ আর গাট্টি বোঁচকা নিয়ে কুকুরকে নিয়ে বসে আছেন কেউ কেউ৷ সেখানেই কথা হলো ডানিয়েলের সঙ্গে৷ বছর বিশেক বয়স তাঁর৷ ডানিয়েল'এর নিজের কথায়, ‘‘আমাদের দেখলেই অনেকে ভ্রু কুঞ্চিত করে৷ ভাবে প্রতিটি গৃহহীন মানুষ, আর আমরা এক একজন ভিক্ষুক৷ আমাদের একটি ময়লা ব্যাগ থাকবে, গায়ে চাপানো থাকবে আধ ময়লা কোট৷ একটি পয়সার জন্যও যে আমরা হাত পাতি৷ কিন্তু তারা ফিরে চায় না৷ তারা কী জানে না, আমরাও মানুষ ?''
পল আর ডানিয়েলরা যে জায়গায় থাকেন সেখানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন তরুণ কর্মী কাজ করছেন৷ এই সংগঠনের নাম ‘ওয়াসে'৷ নদী ঘেষা ঐ জায়গাটির নামে হয়েছে এই নাম৷ খোলা জায়গায় সেখানে রয়েছে অনেকে অনেক তাঁবু৷ খোলা ঐ প্রান্তরটিতে চলছে মূলত নির্মান কাজ৷ সেখানেই তাঁদের দেখভাল করছেন ওয়াসের সঙ্গে জড়িত মাত্র ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী৷
এরাই এখানে আসা মানুষদের নানা ধরণের সহযোগিতা দিচ্ছে৷ যেমন বললেন এই সংগঠনের অন্যতম একজন সাবিনা রোথার৷ তিনি জানান, ‘‘আমাদের এখানে যাঁরা আসেন, সেই গৃহহীন মানুষরা নানা প্রশ্ন করেন৷ এই যেমন, তাঁরা কোথায় ঘুমাবে, কোন জায়গা থেকে তাঁরা সরকারি বা সামাজিক সুযোগ-সুবিধাগুলি পেতে পারেন ইত্যাদি৷ অনেকে এখানে আসেন শুধুমাত্র আড্ডা মারতে৷ তাঁরা আসেন একটু পানীয় পানের জন্য, মন খুলে কথা বলার জন্য৷ এমনকি বিকেলে বই বা অন্য কিছু পড়ার জন্য, কিংবা দুপুরে স্বল্প মূল্যে খাবারের জন্যও আসেন তাঁরা৷''
খাবারের ব্যাপারটা যখন আসলোই তখন জানিয়ে রাখা ভালো, ঐ সংগঠন এসব মানুষদের জন্য ৫০ সেন্ট বা এক ইউরোর বিনিময়ে খাবারের ব্যবস্থা করেছে৷ সেই খোলা প্রান্তরেই হয় রান্না-বান্না৷ সপ্তাহে তিন দিন এই কাজের দায়িত্ব সিফেনের৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমিও এক সময় ছিলাম গৃহহীন৷ রাস্তায় থাকতাম৷ তাই আমি জানি তাঁদের কী দুঃখ৷ তাঁদের সমস্যার কথা আমি জানি৷ রাস্তায় থাকাটা একটি মানুষের জন্য যে কতোটা কষ্টকর, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কে বুঝবে ! অনেক কষ্ট তাঁদের৷ বিশেষ করে শীতের সময়ে৷ আমি এখানে কাজ করার ফলে তাঁদেরকে বুঝতে পেরেছি৷ আমি সকলের সাথে বেশ মজা করি, তাঁদের সঙ্গে আমার আড্ডাও জমে বেশ৷''
প্রসঙ্গত, কোলন শহরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন যে, তাঁরা এই গৃহহীন মানুষদের সরকারি নিয়ম অনুসারে সুবিধাদী দিচ্ছেন৷ কর্মহীন মানুষকে আবাস দিতে, কাজ দিতে চেষ্টা চালিয়েও যাচ্ছেন তাঁরা৷
প্রতিবেদন: সাগর সরওয়ার
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ