জার্মানিতে অপরাধ কমলেও ভীতি বাড়ছে
৮ মে ২০১৮পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জার্মানি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলির অন্যতম৷ কিন্তু জার্মানির মানুষ বলছেন, তাঁরা নিজের দেশে আগে কখনো এত বিপন্ন বোধ করেননি৷ কিসের ভয় তাঁদের?
বাস্তবতা হলো এই যে, ২০১৭ সালে জার্মানিতে দণ্ডনীয় অপরাধের সংখ্যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে কমেছে৷ ২০১৬ সালের তুলনায় বাড়িতে ঢুকে চুরির সংখ্যা কমেছে ২০ শতাংশ৷ এমনকি যুবকদের অপরাধের সংখ্যাও নাটকীয়ভাবে কমেছে৷ তাহলে নাগরিকরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জার্মানিতে আজ বাস্তব পরিসংখ্যানের চেয়ে আবেগ-অনুভূতি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে৷ জার্মানির অপরাধ বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিয়ান ফাইফার ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘এটা মিডিয়ার সৃষ্ট: শুধু খারাপ খবরই ভালো খবর৷''
‘মিডিয়া নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বাড়িয়েছে'
২০১৭ সালে জার্মানিতে পুলিশের খাতাপত্রে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা তার আগের বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৫৭ লাখ ৬০ হাজার৷ অপরদিকে টেলিভিশন অনুষ্ঠান মানেই কোনো না কোনো ধরনের অপরাধ কাহিনী, প্রতি সন্ধ্যায় টিভি স্ক্রিন জুড়ে খুন ও নরহত্যা – একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি, বলেছেন লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের অপরাধবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও সাবেক আইনমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান ফাইফার৷ তবে তিনি মনে করেন, সেটাই একমাত্র কারণ নয় – আবেগ-অনুভূতিগত কারণও রয়েছে৷
‘‘জার্মানদের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ দেখা দিয়েছে, কেননা, আমাদের এখানে এত বেশি বিদেশি-বহিরাগত বাস করছেন,'' বলেছেন ফাইফার৷ ‘‘‘হাইমাট' বা স্বদেশ ও তার সঙ্গে যুক্ত নিরাপত্তার অনুভূতি হারাতে বসেছে৷''
ফাইফারের মতে, জার্মানি বর্তমানে একটি প্রক্রিয়ারমধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যা অভিবাসনের লক্ষ্য সব দেশই কোনো-না-কোনো সময় অভিজ্ঞতা করে থাকে, যখন বিপুল সংখ্যক অভিবাসী হঠাৎ সে দেশে এসে পৌঁছান৷ অথচ মানুষজন যুগ যুগ ধরে শুনে আসছেন যে, বিদেশি-বহিরাগত মানেই বিপজ্জনক, যা থেকে এই নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টি হয়, বলে ফাইফারের ধারণা৷
বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলিতে অভিবাসীর সংখ্যা গত কয়েক বছরে বিশেষভাবে বাড়ার ফলে ‘‘স্বদেশ হারানোর অনুভূতি'' দেখা দিয়েছে, বলে ফাইফারের অভিমত৷ বাস্তবিক অপরাধের সংখ্যা বাড়লো না কমল, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই৷
অভিবাসী নলতে যা বোঝায়
আজকাল অপরাধের পরিসংখ্যানের প্রসঙ্গ উঠলেই বিদেশি-বহিরাগত, বিশেষ করে অভিবাসীদের দিকে নজর দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে যাঁরা রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন, তাঁদেরও অভিবাসী বলে গণ্য করা হয়৷ অভিবাসী বলতে মোটামুটি বোঝায়:
- রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী;
- যাঁদের বর্তমানে বহিষ্কার করা সম্ভব নয় বলে সাময়িকভাবে জার্মানিতে বাস করতে দেওয়া হচ্ছে;
- যাঁদের জার্মানিতে বৈধভাবে অবস্থানের অনুমতি নেই;
- যাঁরা স্বদেশে গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি থেকে পলায়নের কারণে সম্পূরক সুরক্ষা পাচ্ছেন;
- আন্তর্জাতিক ত্রাণ কর্মসূচির কারণে যেসব উদ্বাস্তুকে জার্মানিতে প্রেরণ করা হয়েছে৷
পকেটমারি থেকে শুরু করে ধর্ষণ ও যৌন হামলা, শারীরিক আক্রমণ ও হুমকি এবং চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধের ক্ষেত্রে অভিবাসীপটভূমির সম্ভাব্য অপরাধীদের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে বেশি৷
এর একটা কারণ এই যে, ‘‘বিদেশিদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার সম্ভাবনা জার্মানদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি,'' বলেন ফাইফার৷
উদ্বাস্তু সংকটের আগেও যুব-তরুণরা এমনই ছিল
‘‘২০১৪ সালের আগেও ১৪ থেকে ৩০ বছরের যুব-তরুণরা সবচেয়ে সমস্যাকর গোষ্ঠী ছিল,'' অথচ তখন উদ্বাস্তু সংকট শুরু হয়নি – বললেন ফাইফার৷ তখনও সম্ভাব্য অপরাধীদের অর্ধেক ছিল যুব-তরুণ, যদিও তারা অনুপাতে জনসংখ্যার নয় শতাংশের বেশি নয়৷
যুদ্ধ পলাতক উদ্বাস্তুদের এক-চতুর্থাংশ তরুণ৷ উত্তর আফ্রিকার ক্ষেত্রে প্রতি দু'জন যুদ্ধ পলাতক উদ্বাস্তুর মধ্যে একজন তরুণ৷ অথচ এই তরুণ, পুরুষ, যুব জনতার মধ্যে অনেককেই তাদের স্ত্রী অথবা বান্ধবীদের দেশে ফেলে আসতে হয়েছে৷ অপরদিকে তাদের জার্মানিতে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার সম্ভাবনা কম৷
‘‘মহিলাদের অনুপস্থিতিটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়,'' বলেন অপরাধ বিজ্ঞানী ফাইফার৷ ‘‘মহিলারা সাধারণত শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করে থাকেন৷ তাঁরা না থাকলে, পুরুষসুলভ ‘মাচো' মনোবৃত্তি আরো প্রকট হয়ে ওঠে৷''
হর্স্ট জেহোফারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বাস্তু পরিবারবর্গের একত্রীকরণ সীমিত করতে বদ্ধপরিকর – এমনকি নিকটাত্মীয়দেরও সহজে জার্মানিতে আসতে দেওয়া হবে না, এই হলো পরিকল্পনা৷ কিন্তু অভিবাসী যুব জনতার মধ্যে অপরাধের প্রবণতা কমানোর জন্য কি তাদের পরিবারবর্গকে এখানে আসতে দেওয়াই সঠিক পন্থা নয়?
‘হ্যাঁ' এবং ‘না', বললেন ফাইফার৷ একদিকে ভালো – অপরদিকে ‘‘রাষ্ট্র যে তার বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অভিবাসীদের জন্য কী করতে পারে, জার্মানি তা উপলব্ধি করছে এবং আমি সেটা উপলব্ধি করতে পারি,'' বললেন ফাইফার৷
অলিভার পিপার/এসি