জার্মান রাজনীতিতে ট্রাম্পের ঝাঁকি
২২ জানুয়ারি ২০২৫জলবায়ু সুরক্ষা নীতি বাতিল এবং ইউরোপীয় পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক আরোপের হুমকি দেওয়া, পানামা খাল এবং গ্রিনল্যান্ড দখলে নেয়ার মতো নব্যসাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা, অনেক জার্মান রাজনীতিবিদই ট্রাম্প আর কী কী করতে পারেন তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন।
তা সত্ত্বেও শপথ গ্রহণের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করা ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ।
ভবিষ্যতের জন্য তার ‘শক্তি এবং সাফল্য' কামনা করে শলৎস আরো বলেন, "আমরা একসঙ্গে কাজ করলে আটলান্টিকের দুই তীরে স্বাধীনতা, শান্তি এবং নিরাপত্তা, একই সঙ্গে সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গতি প্রদান করতে পারি।"
কিন্তু ওয়াশিংটনের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এসপিডি) এর শলৎস, ছিলেন না জার্মানির বিরোধীদলীয় নেতা রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) এর ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎসও। ট্রাম্প কেবল রাজনৈতিকভাবে সমমনা রাজনীতিবিদদেরই শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি এবং আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি হাভিয়ের মাইলির মতো নেতারা।
কূটনৈতিক বিপত্তি
অনেক জার্মান রাজনীতিবিদই আকারে ইঙ্গিতে বা প্রকাশ্যেই বলেছেন যে তারা ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসকেই হোয়াইট হাউসে দেখতে চেয়েছিলেন।
জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেবল অতি-ডানপন্থি অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) দলই আরেকটি ট্রাম্প প্রশাসনের অপেক্ষায় ছিল বলে মনে করা হয়। ট্রাম্পের অনুগত ইলন মাস্ক তার সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ খোলাখুলিভাবেই এএফডিকে সমর্থন করে লিখেছিলেন, "[কেবলমাত্র] এএফডিই জার্মানিকে বাঁচাতে পারে"। জার্মান চ্যান্সেলর শলৎসকে "অযোগ্য বোকা" বলেও অভিহিত করেছিলেন তিনি।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রে জার্মানির রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেয়াস মিশেলিসের ফাঁস হওয়া একটি গোপন বার্তা উত্তেজনা বাড়াতে আরো ভূমিকা রেখেছে।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবককে পাঠানো ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করে লেখা একটি কূটনৈতিক তারবার্তা মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে গেছে। রাষ্ট্রদূত বার্তায় বলেছেন, ট্রাম্প "সর্বোচ্চ ব্যাঘাত" ঘটানোর এজেন্ডা অনুসরণ করছেন এবং তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মূলত মৌলিক গণতান্ত্রিক নীতি এবং মার্কিন নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য ব্যবস্থাকে ক্ষুণ্ণ করছেন।
মধ্য-ডানপন্থি সিডিইউ এর চ্যান্সেলর প্রার্থী ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস, এই বার্তা ফাঁস হওয়ার ঘটনাকে জার্মান-মার্কিন সম্পর্কে একটি বিপর্যয় বলে মন্তব্য করেছেন।
জার্মান ব্রডকাস্টার ডয়চলান্ডফুংককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যার্ৎস বলেন, "এটি ওয়াশিংটনে জার্মান সরকারের সুনামের ওপর একটি বিশাল আঘাত। এই ফেডারেল সরকারের কেউ খুব শিগগিরই ওয়াশিংটনে কোনও মধ্যস্থতাকারী খুঁজে পাবে না।"
ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান
চ্যান্সেলর শলৎস ট্রাম্পের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন এবং গ্রিনল্যান্ড নিয়ন্ত্রণে নেয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের দাবির তীব্র সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে ম্যার্ৎস এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
জনমত জরিপ অনুসারে ২৩শে ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচনে জার্মানির পরবর্তী চ্যান্সেলর হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন ম্যার্ৎস। তেমনটা হলে জার্মান সরকারের প্রধান হিসেবে তাকেই ট্রাম্পের বর্তমান প্রশাসনকে মোকাবিলা করতে হবে।
ম্যার্ৎস বলেছেন যে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে "চোখে চোখ রেখে" কথা বলতে চান এবং "ইউরোপের স্বার্থ ঐক্যবদ্ধ করার" উপর মনোনিবেশ করতে চান।
বার্লিনে মধ্য-ডানপন্থি ইউরোপীয় দলগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, "যতক্ষণ ইউরোপের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকবে, ততক্ষণ তারা বিশ্বে সম্মানিত হবে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। যতক্ষণ তারা বিভক্ত থাকবে, ততক্ষণ কেউ আমাদের গুরুত্ব সহকারে নেবে না। সুতরাং, আমার মতে, এটিই চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।"
ট্রাম্পকে পাঠানো হাতে লেখা এক অভিনন্দনপত্রে ম্যার্ৎস আরও লিখেছেন, "যদি জার্মান জনগণ আমাকে চ্যান্সেলর পদের দায়িত্ব দেয়, তাহলে আমাদের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ে আপনার সঙ্গে কাজ করা আমার অগ্রাধিকারের মধ্যে একটি হবে।"
জার্মানির কট্টরপন্থিদের আমন্ত্রণ
ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন জার্মান চ্যান্সেলর ছিলেন সিডিইউ-এর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। এবারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্ব অব্যাহত রাখার পক্ষে কথা বলেছেন ম্যার্কেল।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক স্মৃতিকথায় দীর্ঘদিনের এই রাজনীতিবিদ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তার নানা সংকটের কথা খোলাখুলিভাবেই প্রকাশ করেছেন।
সিডিইউ এর এক অনুষ্ঠানে ম্যার্কেল বলেছেন, অ্যামেরিকার সঙ্গে জার্মানির ট্রান্সআটলান্টিক অংশীদারত্ব কয়েক বছর আগের তুলনায় এখন আরও বেশি অপরিহার্য। তার মতে, "[রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির] পুটিন যাতে যুদ্ধে জয়ী না হন এবং ইউক্রেন যেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকে" সেটা অর্জন করা সম্ভব কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা এবং ন্যাটো জোটের মাধ্যমে।
ট্রাম্প অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন বন্ধ করতে চান এবং পুটিনের সঙ্গে যুদ্ধের দ্রুত অবসান চান। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ইউক্রেনকে নিজেদের বড় একটি এলাকা রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে হবে।
এদিকে জার্মান পার্লামেন্টে এতদিন প্রায় একঘরে থাকা অতি-ডানপন্থি এএফডি ট্রাম্পের দায়িত্ব নেয়ায় নিজেদের দলের উত্থানের আশা দেখছে।
অভিবাসন এবং জ্বালানি নীতি ইস্যুতে এএফডি এবং ট্রাম্পের নীতি অনেকটাই কাছাকাছি। অন্যদিকে, এএফডি প্রায়ই মার্কিনবিরোধী বক্তব্যও দেয়। তা সত্ত্বেও, ওয়াশিংটনে এএফডি এর সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠতা স্পষ্ট। ফেডারেল চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো না হলেও এএফডি এর দুই অন্যতম শীর্ষ রাজনীতিবিদ, টিনো ক্রুপাল্লা এবং বিয়েট্রিক্স ভন স্টর্চ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ক্রিস্টোফ হাসেলবাখ/এডিকে