জার্মান নাগরিকদের জন্য নতুন ইলেকট্রনিক পরিচয়পত্র
১ নভেম্বর ২০১০বাধ্যতামূলক পরিচয়পত্র
জার্মানিতে প্রত্যেক নাগরিকের একটি সচিত্র পরিচয়পত্র রয়েছে, যা সবসময় কাছে রাখতে হয়৷ তাতে নাম, স্থায়ী ঠিকানা, বয়স, জন্মদিন ইত্যাদি নানা তথ্য লেখা থাকে৷ এই নাগরিক পরিচয়পত্র নিয়ে এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি দেশগুলিতেও যাতায়াত করা যায় – সঙ্গে পাসপোর্ট রাখারও দরকার নেই৷ শুধু তাই নয়, জার্মানিতে কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে গেলে প্রত্যেক নাগরিককে স্থানীয় সরকারি দপ্তরে গিয়ে নথিকরণ করতে হয় – এমনকি বিদেশিদের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য৷
এতকাল শুধু ল্যামিনেট করা এই জাতীয় সচিত্র পরিচয়পত্র নিয়েই কাজ চলে যাচ্ছিলো৷ যে কোনো জায়গায় পরিচয়ের প্রমাণ দিতে হলে এই পরিচয়পত্রই ভরসা৷ সরকারি-বেসরকারি সব দপ্তর থেকে শুরু করে পোস্ট অফিস থেকে পার্সেল আনতে গেলেও দেখাতে হয় এই পরিচয়পত্র৷ তবে পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েও অনেক জায়গায় কাজ চালানো যায়৷
নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ
একবিংশ শতাব্দীর এই তথ্য-প্রযুক্তি সর্বস্ব জীবনযাত্রায় অনেক কাজই হচ্ছে ‘ভারচুয়াল' বা অদৃশ্য জগতে – সশরীরে উপস্থিত থাকার কোনো প্রয়োজন নেই৷ ব্যাঙ্কিং থেকে শুরু করে সিনেমা, ট্রেন, বাস, বিমানের টিকিট কাটা, কেনাকাটা করা, নানা রকম পরিষেবার সুযোগ নেওয়া – এসবের জন্যই মানুষ আরও বেশি করে ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হচ্ছেন৷ এমন যুগে শুধু ল্যামিনেট করা এই কাগজের পরিচয়পত্র চলতে পারে না৷ তাই জার্মানিতে শুরু হয়েছে যুগোপযোগী পরিচয়পত্র সহ বেশ কিছু উদ্যোগ, যা বর্তমান যুগের চাহিদা পূরণ করতে পারবে৷
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হচ্ছে সচিত্র জাতীয় পরিচয়পত্রের আধুনিকীকরণ৷ ১লা নভেম্বর থেকে চালু হল এই ইলেকট্রনিক পরিচয়পত্র৷ দেখতে হুবহু ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মতো৷ বর্তমান পরিচয়পত্রের মতো এই হাই-টেক কার্ডের মধ্যেও নাগরিকের ছবি ও অন্যান্য তথ্য লিখিত অবস্থায় থাকবে৷ সেইসঙ্গে থাকছে এক চিপ, যার মধ্যে ভরা থাকছে আরও অনেক গুণাগুণ৷ মূল উদ্দেশ্য, ইন্টারনেটের মাধ্যমেও নিজের পরিচয় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা৷ তবে এই হাই-টেক পরিচয়পত্রের সব গুণাগুণ সবাইকে ব্যবহার করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই৷ স্বেচ্ছায় বাড়তি সুযোগ নিতে চাইলে থাকছে নতুন দুটি বৈশিষ্ট্য৷ প্রথমটির নাম ‘ই-আইডি' – অর্থাৎ ‘ইলেকট্রনিক আইডেন্টিটি'৷ এর মাধ্যমে অনলাইন পদ্ধতিতে নিজের পরিচয়ের প্রমাণ দেওয়া যাবে৷ দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে অনলাইন পদ্ধতিতে স্বাক্ষরও করা যাবে৷ সরকারি-বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান এই অনলাইন পদ্ধতির সুযোগ নিতে পারবে৷ ফলে ঘরে বসেই কম্পিউটারের মাধ্যমে যে কোনো নাগরিক এমন অনেক কাজ সেরে ফেলতে পারবেন, যার জন্য এতকাল বেশ দৌড়ঝাঁপ করতে হতো৷
নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা
গোটা প্রকল্পের উদ্দেশ্য অত্যন্ত যুগোপযোগী – কোনো সন্দেহ নেই৷ এর ফলে নাগরিকদের জীবনযাত্রাও অনেক সহজ হয়ে পড়বে, সময়ও অনেক বাঁচবে৷ কিন্তু ইন্টারনেট যেমন অনেক কাজ সহজ করে তোলে, তেমন ইন্টারনেটে বিপদেরও অভাব নেই৷ ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের অনেক পরিষেবার ক্ষেত্রে অপরাধ ও অপব্যবহারের ঘটনার অভাব নেই৷ ইলেকট্রনিক পরিচয়পত্রের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা কতটা বৈধ? জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হেনিং ক্যোলার গত মার্চ মাসে সেবিট মেলায় বলেছিলেন, ‘‘নতুন এই পরিচয়পত্রের ক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিচ্ছি৷ বিভিন্ন পর্যায়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে৷ পরিচয়পত্রের সঙ্গে পিন নম্বর লাগবে৷ যদি কেউ আমার পিন জানতে পেরে যায়, বাড়িতে বসেই আমি সেই পিন বদলে ফেলতে পারবো৷ অর্থাৎ আমিই এই কাজ করতে পারবো৷ তবে অবশ্যই নিজের জন্মদিনের মতো সংখ্যা পিন হিসেবে ব্যবহার করা উচিত হবে না৷ এই পিন কোথাও লিখে রাখাও উচিত হবে না৷ এই সব সাবধানতা অবলম্বন করলে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না৷''
সমাধানসূত্র
সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে৷ এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছ, কীভাবে সহজেই কারো পিন নম্বর জেনে ফেলা যায়৷ জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টোমাস দেমেজিয়ের অবশ্য সব সমালোচনা অস্বীকার করে বলেছেন, গোটা বিশ্বে অন্য কোথাও এত নিরাপদ পরিচয়পত্র নেই৷ তিনি নিজে ১লা নভেম্বর থেকে নতুন এই পরিচয়পত্র ব্যবহার করবেন এবং অন্যদেরও করার পরামর্শ দিয়েছেন৷
জার্মান সরকারের তথ্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা পেটার শার অবশ্য এই সমস্যার অন্য এক সমাধানসূত্র তুলে ধরেছেন৷ তাঁর মতে, পিন নম্বর টাইপ করার জন্য সস্তার রিডিং যন্ত্র একেবারেই উপযুক্ত নয়৷ তাই শুরু থেকেই আলাদা বিশেষ যন্ত্রের নিজস্ব কিবোর্ডের মাধ্যমে পিন কোড টাইপ করা বাধ্যতামূলক করা উচিত৷ সেই যন্ত্রের দাম কিছুটা বেশি হতে পারে, তবে একবার এমন যন্ত্র কিনলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবিরতি গুহ