জার্মানির আদর্শ শিক্ষার্থী
৬ জানুয়ারি ২০১৪বলছিলাম কোরিয়ান অভিবাসীদের সন্তানদের নিয়ে৷ জি-উন কিম এ কথাটা আর শুনতে চান না৷ ‘‘কেমন করে আপনি এত ভালো জার্মান বলেন? এখানে কী বেশি দিন থাকবেন, না এক সময় ফিরে যাবেন?'' এর উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করেন ৩৮ বছর বয়সি কিম, ‘‘আপনি কী বার্লিনের টিয়ারগার্টেন নাকি স্পানডাও-এর কথা বলছেন?''
এক প্রজন্মেই অনেক ধাপ এগিয়েছেন
কোরিয়ানরা এক প্রজন্মেই অনেক ধাপ এগিয়ে গেছেন৷ শ্রমিক থেকে হয়েছেন অ্যাকাডেমিক ৷ ১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে কিমের মা-বাবা আরো ২০,০০০ কোরিয়ানের সঙ্গে খনি শ্রমিক ও নার্স হিসাবে জার্মানিতে আসেন৷ আদলে ১৯৬৩ সালের জার্মান-কোরিয়ান চুক্তির আওতায় এখানে আসেন তাঁরা৷
আজ ৫০ বছর পর ফেডারেল পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২৬,০০০ কোরিয়ান বসবাস করেন জার্মানিতে৷ নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের ধরা হলে এই সংখ্যাটা ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ হবে৷ তুলনামূলকভাবে ছোট এক অভিবাসী গোষ্ঠী৷ আর তাই হয়ত তাঁদের তেমন করে চোখে পড়ে না৷ তবে দ্বিতীয় প্রজন্মের কোরীয় বংশোদ্ভূত জার্মানরা যে ভালো করছেন, সেটা প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখা হয়৷ এর মধ্যে রয়েছেন জি-উন কিম৷ জার্মান সমাজে ইন্টিগ্রেশনের ব্যাপারে কোরীয়দের তুলনা হয় না৷ তাঁদের বলা হয় আদর্শ শিক্ষার্থী৷
কিম দুটি বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা শেষ করেছেন, আইন ও সংস্কৃতি ব্যবস্থাপনা৷ একজন সফল আইনজীবী ছিলেন তিনি৷ তবে এখন ডক্টরেট করছেন৷বলা বাহুল্য, ৭০ শতাংশ কোরিয়ান ‘আবিট্যুর', অর্থাৎ ১২ ক্লাস পাশ৷ অনেকেরই আবার রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও৷ কিন্তু এই শিক্ষার সাফল্য কী সফল ইন্টিগ্রেশন এনে দিতে পারে? এই ব্যাপারে সন্দিহান কিম৷
অনেকের আচরণ ছিল দুঃখজনক
ছেলেবেলায় অনেকের আচরণে মনে কষ্ট পেতেন তিনি৷ যখন তাঁর উদ্দেশ্যে বলা হতো ‘শিং, শাং, শোং'৷ কিংবা ডাকা হতো ‘এই চীনা' বলে৷ কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে বর্ণ বৈষম্য নিয়ে এতটা চিন্তিত নন কিম৷ আসলে এটা একটা সামাজিক কাঠামোগত সমস্যা৷ আর সেটাই তাঁকে উদ্বিগ্ন করে৷
বার্লিনে তাঁর জার্মান সহপাঠী ছিল৷ গিমনাসিউম বা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি৷ অর্থাৎ এই সমাজে ভালোভাবে সম্পৃক্ত এক মানুষ৷ কিন্তু ‘‘সমাজে যুক্ত হওয়ার এক আদর্শ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠলেও, তাঁকে নিয়ে বৈষম্য দূর হয়নি'', বলেন কিম৷
একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন আরেক কোরিয়ান ইউ জায় লি৷ ট্যুবিংগেন ইউনিভার্সিটির কোরিয়ানোলজির প্রফেসর তিনি৷ কোরিয়ানদের অভিবাসন নিয়ে গবেষণা করছেন৷ ‘‘১.৫ বা দেড় প্রজন্মের কোরিয়ান'' বলে মনে করা হয় এই গোষ্ঠীকে৷ লি ছোটবেলায় এসেছেন জার্মানিতে৷ দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেক জার্মান-কোরিয়ান ভালো ক্যারিয়ার গড়লেও এক সময় তাঁরা লক্ষ্য করেন যে আর বেশি দূর যাওয়া যাচ্ছে না৷ যেন এক কাচের দেওয়ালে বাধা পান তাঁরা, জানান প্রফেসর লি৷
মা-বাবার আশা, আকঙ্খা
অন্যদিকে মা-বাবারা আশা করেন, জার্মান সহপাঠীদের তুলনায় দ্বিগুণ পরিশ্রম করলে সফল হবেন তাঁদের সন্তানরা৷ সমাজও তাঁদের সেই রকম স্বীকৃতি দেবে৷ শিক্ষা ক্ষেত্রে এত উদ্দীপনা সত্ত্বেও কোরিয়ান ছেলে-মেয়েরা যাতে তাঁদের শেকড়ের কথা ভুলে না যান, সেজন্য সপ্তাহান্তে কোরিয়ান স্কুলে কোরিয়ান ভাষা শেখানো হয়৷
প্রথম প্রজন্মের কোরিয়ানরা নেটওয়ার্কটা বেশ সুগঠিত৷ পরস্পরের দেখা সাক্ষাৎ হয় গির্জায়. স্পোর্টস সমিতিতে, কোরিয়ান ক্লাসে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে৷ কিমের মা-বাবা বলেন, ‘‘আমরা কোরীয়, এটা তো স্পষ্টই৷'' দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়ের জন্ম হয়েছে জার্মানিতে৷ তাঁরা বড়ও হয়েছেন এই দেশটিতে৷ শুধু ছুটি ছাটায় কোরিয়ার সঙ্গে পরিচয় তাদের৷ ‘‘দ্বিতীয় প্রজন্মে কোরিয়ানরা নিজেদের এই সমাজেরই সদস্য বলে মনে করেন এবং এখানেই তাঁরা অবদান রাখতে চান৷'' বলেন অভিবাসন গবেষক ইউ জায় লি৷ এখানেই মা-বাবার সঙ্গে পার্থক্যটা তাঁদের৷
অল্পবয়সিরা অনেক খোলামেলা
এছাড়া অল্পবয়সিরা অনেক বেশি খোলামেলা৷ তাঁরা বিয়ে করেন অকোরিয়ানদেরও, বন্ধুত্ব করেন বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে৷ গড়ে তোলেন কোরীয় জার্মান সমিতি৷ জার্মানিতে কোরীয় রেস্তোঁরা চোখে পড়ে বার্লিন থেকে ফাংকফুর্ট পর্যন্ত৷ সামসুং ও হুন্ডাই-এর মতো বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানও জায়গা করে নিয়েছে জার্মানিতে৷
তবে জি-উন কিম আর ইউ জায় লি-এর কাছে এ সবই যথেষ্ট নয়৷ তাঁদের আশা, তৃতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের যেন অনবরত এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়: ‘‘তুমি কী কোরিয়ান, নাকি জার্মান?'' একান্ত স্বাভাবিকভাবেই যেন জীবন কাটাতে পারেন তাঁরা এখানে৷